আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ৪ জনকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিচারক। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। এসময় মিন্নিসহ ৯ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। হত্যার ঘটনায় মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। ফাঁসির আদেশের পরই মিন্নিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পরপর নিহত রিফাতের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ বায়েজিদ সামাজিক যোগাযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাসের বাস্তবতা অনেকটা প্রমাণিত হয়েছে মামলার রায়ে। এজন্য তার সেই স্ট্যাটাসটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে বায়েজিদ লিখেন, ‘রিফাত শরীফের হত্যার ভিডিওটাতে দেশবাসী যা দেখছে সেটাতে রিফাত ভাইয়ের বউ মিন্নি নির্দোষ। কিন্তু ভেতরের খবরটা সবারই অজানা! এই মিন্নি গত ঘটনার দিন সকাল ১০টায় রিফাত শরীফকে বরগুনা সরকারি কলেজে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুনি নয়নের সঙ্গে নিজের স্বামীকে হত্যা করে।’

বায়েজিদ আরও লিখেন, ‘প্রথমে কলেজের ভেতরে বসে রিফাত শরীফকে নয়ন, রিফাত ফরাজি, রিশাদ ফরাজি ও অন্যান্য সহযোগীরা লাঠি ও চটপটি ভ্যানের লম্বা চামচ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে। তখন মিন্নি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল। মারামারির এক পর্যায় মারতে মারতে রিফাত শরীফকে কলেজ গেটের সামনে নিয়ে যায় এবং চলন্ত রাস্তার মধ্যে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তখন মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর যে নাটকটা করেছে সেটার কারণে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজটির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পাবলিসিটি পেয়ে যায়। কিন্তু পাবলিসিটি দেয়া মানুষগুলো জানে না এই মিন্নি খুনি নয়নের সাথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।’

বায়েজিদ লিখেছেন, ‘আপনারা খেয়াল করেছেন চাপাতি দিয়ে রিফাতকে কোপানোর সময় মিন্নিকে একটা আঘাতও করেনি সন্ত্রাসীরা! কারণ নয়নের সঙ্গে মিন্নি পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। দুজনে এক সাথে ইয়াবা সেবন করত। বলে রাখা ভালো নয়ন বরগুনা জেলার মাদক সিন্ডিকেটর মূল নায়ক। যার নামে বরগুনা সদর থানায় কমপক্ষে ২০টা মামলা আছে। কলেজের ভেতরে মারামারি হওয়া আগ মুহূর্তে রিফাত শরীফ মিন্নিকে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইলে মিন্নি বিভিন্ন বাহানায় রিফাতকে আটকে রেখেছিল। রিফাত ভাই যদি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করত তাহলে হয়তো বেঁচে যেত। হায়রে ভালোবাসার মেয়েটাকে ভাই ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দা, চাপাতির যন্ত্রণা সহ্য করেছে। শেষে রক্তাক্ত রিফাত ঘাড় হতে গলা পর্যন্ত গুরুতর জখম নিয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালে যায় এবং মিন্নি বরগুনা সদর হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে যায়।’

আলোচিত এ মামলার রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার পরপরই মিন্নিকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা হলেন, ১. রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি (২৩), ২. আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন (২১), ৩. মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), ৪. রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), ৫. মো. হাসান (১৯), ৬. আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। এছাড়া খালাসপ্রাপ্তরা হলেন, মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯), ও কামরুল ইসলাম সাইমুন (২১)। পলাতক মুসা ব্যতীত বাকিরা রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মিন্নির বাবা মোজাম্মমল হক কিশোর বলেন, আমার মেয়ে অপরাধী না। আমি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবো। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে আমার মেয়ে কিছুই জানে না, তারপরও রায় দেওয়া হয়েছে ফাঁসি। তাকে নির্দোষ প্রমাণে আমরা উচ্চ আদালতে যাবো। এ মামলায় গত বছরের ১৬ জুলাই মিন্নি গ্রেপ্তার হয়, ২৯ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে উচ্চ আদালত এবং ৪৯ দিন পর কারাগার থেকে মুক্ত হন মিন্নি। মামলার একমাত্র জামিনে থাকা আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিরুদ্ধেও হত্যার পরিকল্পনা ও সরাসরি অংশ নেয়ার অভিযোগে ৩৪ ও ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।

২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের ভিড়ে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দু’ভাগে বিভক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এরপর ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত। এ মামলায় মোট ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর এ মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান রায়ের জন্য বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেন। বুধবার মামলার রায় শুনতে আদালতে রিফাতের পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও মামলার আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও আসামিদের স্বজনরা হাজির হয়। আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়।-পূর্বপশ্চিমবিডি

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn