চীনা প্রবাদে আছে, If you are planning for a year, sow rice; if you are planning for a decade, plant trees; if you are planning for a lifetime, educate people. শিক্ষক শব্দটার মধ্যে অমিত শক্তি ও মর্যাদা লুকিয়ে আছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সম্মান পেয়ে  থাকেন। সম্প্রতি প্রকাশিত খবব্রে দেখলাম, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়ে  অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে  কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিতি,  দায়িত্বে অবহেলা, আয়-ব্যয়, নামে-বেনামে সম্পদের হিসেবসহ সবকিছুরই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুদক টিমের অনুসন্ধানকালে কোনো  শিক্ষকের বিরুদ্ধে কর্তব্য পালনে অবহেলার প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে আইনি  ব্যবস্থা নেয়া হবে। খুব ভালো কথা। কিন্তু যাদের অফিসের তালা দিনের পর দিন খুলেন না, বা খুললেও যাদের পাওয়া যায় না খুব একটা, তাদের ঠিকানা নেই দুদকের কাছে? আমি বলছি না, এখানে শিক্ষকরা সবাই তুলসি পাতায় ধোয়া; কিন্তু অন্য পেশার চোর ডাকাতদের নাম দুদক ভুলে যায় কেনো? আমি এটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে এই খাতে শ্রম দেয়া মানুষগুলো অনেক বেশি সততা লালন করে। আপনি ১০০ শিক্ষক আর ১০০ আমলাকে পাশাপাশি রাখুন। এবার আমলনামা খতিয়ে দেখুন। কী দেখতে পাচ্ছেন?

দুর্নীতি দমন কমিশন  বা  দুদক   বাংলাদেশের একটি স্বাধীন কমিশন, যা দেশের সকল স্তরে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চত করার লক্ষ্যে কাজ করে বলেই আমরা জানি। তবে মজার ব্যাপার হলো-  দুদক কর্মকর্তারা নেতাদের চেনেন না; আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগ চেনেন না, এমনকি দুদক চেনে না যারা ব্যাংক লুট করে। দুদকের কাছে ঠিকানা নেই হাজার টাকা পকেটে ভরে ফেলা আমলাদের।

এই দেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। তবে সেইসব বাদ দিয়ে শুধু শিক্ষকদের দুর্নীতি বন্ধে ব্যাপক উদ্যোগ নিচ্ছে দুদক! সে লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে  সারাদেশের সকল পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নাম সংগ্রহ করা হবে।  কমিশনের পক্ষ থেকে থেকে চিঠি দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের  কাছে কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের কোচিং সেন্টার খুঁজতে দুদক সারাদেশের কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তাতে অনেক সম্মানিত শিক্ষক যে অযথা হয়রানি ও ঝামেলায় পড়বেন, তার নিশ্চয়তা দুদক কি দেবে?

শিক্ষকদের বিষয়ে আমাদের ধর্ম কী বলে একটু দেখি। রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ [ইবনে মাজাহ : হা. ২২৯] তাই তিনি শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের তিনি মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে

না তারা কি সমান হতে পারে?’  [সূরা জুমার:৯]

আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত,  রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,  তোমরা বলতে পার কি দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে?  সাহাবারা উত্তর বললেন,  আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সা.) অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহই হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা বড়। অতঃপর বনি আদমের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর আমার পর বড় দাতা হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ইলম (জ্ঞান) শিক্ষা করবে এবং তার প্রচার-প্রসার করতে থাকবে। কিয়ামতের দিন সে একাই (দলবলসহ) একজন আমির অথবা (রাবির সন্দেহ) একটি উম্মত হয়ে উঠবে। [মিশকাত]

আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং তাঁকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো।’ [আল-মু’জামুল আউসাত : ৬১৮৪]

খেলাফতের যুগে ইসলাম প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল। তৎকালীন সময়ে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে এ খাতে সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও দ্বীনি শিক্ষার শিক্ষকরা  কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন। তবুও তাঁরা যেহেতু নিজেদের জীবিকার পেছনে জীবনের ঘোড়া না লেলিয়ে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তবে তাঁদের এ কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁদের ও তাঁদের পরিবার-পরিজনের দায়িত্বভার নেওয়া নিজেদের ওপর ফরজ করে নিয়েছিল তৎকালীন খেলাফত (সরকার), যাতে শিক্ষকদের জীবনের তাকিদে কোনো ভিন্ন পথে পা বাড়াতে না হয়।

ওমর (রা.) ও ওসমান বিন আফ্ফান (রা.) তাঁদের শাসনামলে এ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাঁরা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন।  যেমন হজরত ইবনুল জাউজি (রহ.) তাঁর গ্রন্থ ‘সিরাতুল উমরাইনে’র মধ্যে উল্লেখ করেন, হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.), হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.)-এর যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো।’ [সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল, পৃ. ১৬৫]

মুসলিম সমাজে শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তাই শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সবার সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো উচিত। কারণ শিক্ষকেরা মানুষ তৈরির কারিগর। শিক্ষকেরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। এককথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয় একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়।

যুগে যুগে শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই কাজ করে আসছেন। অতীতে শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষকের বাড়ি গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। এতে শিক্ষাগুরুরা তাদের জ্ঞান, সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, দর্শন, মন-প্রাণ-অন্তর, এমনকি ভরণ-পোষণসহ শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষা দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুলতেন যেন এরা বড় হয়ে উন্নততর ও উচ্চতর জীবনবোধ এবং বিবেকবোধ নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়।
শিক্ষকরা সবসময়ই আর্থিকভাবে দুর্বল। তাই পরবর্তীতে সময় ও জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাদান পদ্ধতি গড়ে ওঠে এবং শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। শিক্ষকরা যেন নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে শিক্ষাদান করতে পারেন সেজন্য সমাজহিতৈষী, সরকার, এমনকি সমাজের সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় এসব অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মনোযোগী হলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেশ অবহেলা আর উদাসীনতার পরিচয় দেয়। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্য আজও বদলায়নি।
শিক্ষাদানের পাশাপাশি আদমশুমারি, ভোটার তালিকাভুক্তি, টিকাদান, শিশু জরিপ, উপবৃত্তি বিতরণ, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিক্ষকরা সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখার পরও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজরে দেখা হয়। শিক্ষকের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন হয়। অথচ এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত, তাঁদের নেই কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না থাকায় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, এ দুর্মূল্যের বাজারে বেতন-ভাতার অপ্রতুলতা, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের উদ্ভট মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অবহেলাই যেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী।
বলতে লজ্জা হয়,  দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।

শিক্ষক হলেন সেই সব ব্যক্তি যারা শিখন ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।
শিক্ষা-পরিবারে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ছাত্রদের কর্মদক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধেরও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আর এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের বাংলাদেশ। তাই শিক্ষকরা যেনো অযথা হয়রানির শিকার না হোন তা নিশ্চিত করেই যেনো দুদক পা ফেলে। তার আগে কোন খাতে দুর্নীতি বেশি আর কারা বেশি করছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

লেখক হাসান হামিদ কবি ও গবেষক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn