শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলে যাওয়া কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি লিখেছেন, “শিখিবার কালে, বাড়িয়া উঠিবার সময়ে, প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্য—ইহারা বেঞ্চি এবং বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয়” (শিক্ষাসমস্যা)।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে যখন পড়ি, তখন ধানমন্ডির নামকরা এক কোচিং সেন্টারে পড়াতাম। আমি তখন লক্ষ করেছি, আমাদের দেশে বর্তমানে অতি সচেতন এক অভিভাবক শ্রেণি তৈরি হয়েছে; যারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ পর্যায়ের সিরিয়াস। তারা চান তাদের সন্তান যে করেই হোক ক্লাসে প্রথম হবে, গোল্ডেন এ প্লাস পাবে, মেডিক্যাল-বুয়েটে পড়বে এবং তারা তাদেরকে ধন্য করবে। তাদের এই নিম্ন পর্যায়ের সচেতনতায় আমরা ভালো কিছু তো হারাচ্ছি, তাতে দেশ কোন উটের পিঠে যে চড়াচ্ছি তা আর বলতে!

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি যেমন আছে, তেমনি গলদ আছে শিক্ষা বিষয়ে সামাজিক ও পারিবারিক ভাবনা চিন্তায়। আমরা মোটেই বুঝতে রাজি নই, একটি দেশের বা জাতির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তেমন কোনো বড় ভূমিকা রাখেন না। আপনি দেশের সেরা মানুষের তালিকাটায় চোখ বুলান। সেখানে যাদের নাম দেখতে পাচ্ছেন, তারা ডাক্তার?  তাহলে আমরা কেনো এই মূর্খ সংস্কৃতির চর্চা করছি গত কয়েক দশক ধরে। কেনো আমরা এক রকম জোর করে সেরা মেধাবীদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর দিকে ঠেলছি? পৃথিবীর কোন দেশে আছে এটা? না, কোনো দেশে নেই। আর আমরা সেকারণেই পিছিয়ে পড়ছি দারুণভাবে। এ দেশে জন্মালে আইনস্টাইনকে আমাদের এই শিক্ষার অপসংস্কৃতি তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বানাতো। আমাদের দেশের উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, অ্যারিস্টটল, জর্জ বার্নাডস, জন পল ডি জোরিয়া, জ্যাক মা যারা জন্ম নেয়; এদের আমরা বিসিএস ক্যাডার বানিয়ে দেশ উদ্ধার করছি। না, বিসিএস ক্যাডার হবে, কিন্তু সেটা কোনো মানুষের স্বপ্ন হতে পারে না। দেশের সব মানূষ বিসিএস ক্যাডার হলে আমাদের জাতির কী আসবে যাবে? আমরা একবারও ভাবছি না, আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি দেশকে। আড্ডায় বাংলাদেশ নামে যারা আজকে নাক সিটকায়, তারা কেউ ভাবছে না, বাংলাদেশ মানে আমি, আপনি এবং যে নাক সিটকালো; আমরা সবাই। দেশকে উঁচুতে নিতে হলে মেধাবীদের সেভাবে তরি করতে হবে। গোল্ডেন এ প্লাসে কিছু হবে না। শিক্ষা ব্যবস্থার এতো গলদ আর ছাইপাস স্বপ্ন দেখা এ প্রজন্ম কী দিবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে?

বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সিলেবাস দেখলে মাথা ঘুরে যায়। চিলির রাজধানীর নাম কেনো মুখস্থ করবে এরা? পৃথিবীর সেরা শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে খ্যাত ফিনল্যাণ্ডের স্কুলে যখন প্রথম ৬ বছর কোন পরীক্ষা হয় না এবং ১০ বছরের স্কুলজীবন শেষে প্রথম
বড় ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তখন বাংলাদেশে ফার্স্ট টার্ম, মিড টার্ম, বার্ষিক, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি’র মত শত শত পরীক্ষার মুখে শিশুদের মুখোমুখি করে দেয়া হয়; যা তাদেরকে কিছু শেখার আগেই প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়। জাপান এবং কোরিয়ায় যখন ম্যাথ এবং প্রোবলেম সলভিং-এর উপর ফোকাস করে ধীরে ধীরে শিশুদের বড় করা হয়, তখন আমাদের শিশুদের মুখস্ত করার যুদ্ধে নামতে হয়। আর জামার্নিতে শিশুদের স্কুলের প্রথম দিন যখন শিক্ষাসামগ্রীর সাথে খেলনা, ফুল ও মিষ্টান্ন সম্বলিত “স্কুলকোণ” নামক বিশেষ উপহার দেয়া হয়, তখন আমাদের স্কুলে লম্বা বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয় এবং অন্য একজনকে এই ভারী বইয়ের ব্যাগ বহন করে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়। কী ভয়াবহ ব্যাপার!

যতদূর জানি, পড়ার অধিক চাপ হতে মুক্তি দিতে চাইনিজ স্কুলে বাধ্যতামূলক একঘণ্টা বিরতি এবং কিছু স্কুলে নাতিদীর্ঘ ঘুমানোর সুযোগ আছে। অথচ এদেশে চাপ মুক্ত নয়; বরং আরো চাপ যুক্ত হয় যখন স্কুলের পর পর কোচিং, প্রাইভেট, স্যারের বাসায় দৌড়াতে হয়। এদেশে অনেক ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাবার যখন রিকশা, সিএনজি বা গাড়িতে সারতে হয় তখন ইতালি, ফান্স ও মেক্সিকোতে স্কুলের সময় নির্ধারণ করা হয় পরিবারের সাথে লাঞ্চ করার সুযোগ দিয়ে। বেলজিয়ামে ১০ বছর পর্যন্ত যেখানে হোম ওয়ার্ক দেয়ার সিস্টেম নেই সেখানে হোমওয়ার্কের চাপে আমাদের শিশুদের খেলাধুলা এমনকি ঘুমও হারাম হয়ে যায়। একাডেমিক শিক্ষার চাপ লাঘবে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়েও সিঙ্গাপুর কিভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা ব্যবস্হার অধিকারী হয়; তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নীতি-নির্ধারকরা কি একবার ভেবেছেন?

স্কুলজীবনের শুরু হতে কেমন জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় আমাদের শিশুরা তা আমরা জানি। এখানে গোল্ডেন এ প্লাস না পেলে সব শেষ বলে, এ-কে দিয়ে কিচ্ছু হবে না বলে আমাদের বাবা-মায়েরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে অদ্ভুত এক উটের পিঠে চড়িয়ে বসেছেন। এইসব অনর্থক যুদ্ধ তাদের স্বপ্ন দেখায় না, এই যুদ্ধ তাদের সৃষ্টিশীল করছে না, এই যুদ্ধ তাদের যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলছে না, এই যুদ্ধ তাদের আইস্টাইন,  নিউটন,  রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের সৃষ্টি করছে না। এই যুদ্ধ তৈরি করছে একটি হতাশ ও ক্লান্ত প্রজন্ম; যে প্রজন্ম প্রকৃত বিদ্যা হতে বাধ্য হয় দূরে সরে যাচ্ছে! শিশুদের শৈশবের সময় নষ্ট করে কিছু হবে না। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বাচ্চাদের শৈশব চুরি করছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাহলে কেমন হওয়া উচিত? আবারো রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়লো। তিনি লিখেছেন, “শিশুবয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নাই; তাহা মনকে যতটা দেয় তাহার চেয়ে পিষিয়া বাহির করে অনেক বেশি”(পথের সঞ্চয়/শিক্ষাবিধি)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমেই  পুস্তকসাধারণকে ‘পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক’ — এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন। টেক্সট বুক কমিটি নির্বাচিত গ্রন্থগুলোকে তিনি অপাঠ্যপুস্তকের মধ্যে ফেলেছেন। “কমিটি দ্বারা দেশের অনেক ভালো হইতে পারে;  তেলের কল, সুরকির কল, রাজনীতি এবং বারোয়ারি পূজা কমিটির দ্বারা চালিত হইতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত এ দেশে সাহিত্য সম্পর্কীয় কোনো কাজ কমিটির দ্বারা সুসম্পন্ন হইতে দেখা যায় নাই।” মানে হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃঢ় প্রত্যয় কমিটি বিশেষ কিছু বই পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত  করে থাকে, যা শিক্ষার্থীর  বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তিনি মনে করেন, “কমিটি নির্বাচিত পাঠের মধ্যে শিশুকে  নিবদ্ধ রাখিলে তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না”। তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন,“আমরা যতই বিএ, এমএ পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বেশ বলিষ্ঠ এবং পরিপক্ক হইতেছে না।…সেইজন্য আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি”। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, “বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।…হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে, আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়ার দরকার”। মুখস্থ বিদ্যাকে তিনি একপ্রকার নকল করাই ভেবেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত: “শিশুকাল হইতেই কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া সঙ্গে সঙ্গে যথাপরিমাণে চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে”।

এবার স্কুল সম্পর্কে কবিগুরুর ভাবনা কী ছিলো তা লক্ষ করি। তাঁর ভাষায়, “ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে-ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়”। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দ্যেশে বলেছেন: কেবল গ্রন্থগত বিদ্যা নয়, প্রাকৃতিক জ্ঞানভাণ্ডার থেকে নানান উপকরণ আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। “চিত্ত যখন সমস্ত উপকরণকে জয় করিয়া অবশেষে আপনাকেই লাভ করে তখনই সে অমৃত লাভ করে।…নানা তথ্য, নানা বিদ্যার দিয়া পূর্ণতররূপে নিজেকে উপলব্ধি করিতে হইবে।…পরিণত জ্ঞানে জ্ঞানী হইতে হইবে”। বিশ্বকবি বিধাতার কাছে কামনা করেছেন  এভাবে, “আমাদের ছাত্রগণ যেন শুধুমাত্র বিদ্যা নহে, তাহারা যেন শ্রদ্ধা, যেন নিষ্ঠা, যেন শক্তি লাভ করে— তাহারা যেন অভয় প্রাপ্ত হয়, দ্বিধাবর্জিত হইয়া তাহারা যেন নিজেকে নিজে লাভ করিতে পারে”।

তবে হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথার কিছু কিছু বিষয়ের প্রায়োগিকতা নিয়ে এ সময়ের প্রেক্ষাপটে হয়তো কথা থাকতে পারে। তবে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য যা বলেছেন, তা একেবারেই যথার্থ। কবি সুনির্মল বসু বলেছেন: “বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র / নতুন ভাবের নানান জিনিস শিখছি দিবারাত্র”। ঠিক এবিষয়টিকেই কবিগুরু তাঁর মতো বলেছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞানার্জনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। শিক্ষাব্যবস্থার নীতি-নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ, এতো কিছু না হোক, তবে আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শৈশব যেনো ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিং এ আটকা না পড়ে থাকে, কিছু একটা ভাবুন প্লিজ। শুরু করেছিলাম কবিগুরুর কথা দিয়ে, তাই শেষটাও করছি তাঁর বাণী দিয়ে। তিনি আফসোস করে বলেছেন, “তুচ্ছ বিষয়টুকুর জন্যও বই নহিলে মন আশ্রয় পায় না। বইয়ের ভিতর দিয়া জানাকেই আমরা পাণ্ডিত্য বলিয়া গর্ব করি। জগৎকে আমরা মন দিয়া ছুঁই না বই দিয়া ছুঁই”।

লেখক- হাসান হামিদ ,গবেষক সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn