উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতেই ন্যস্ত রইলো। উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের আনীত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।  প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ঐক্যমতের ভিত্তিতে সরকারের আপিল খারিজ করে দেয়।  আপিল বিভাগ বলেছে, হাইকোর্ট রায়ের যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, সেই পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার সাপেক্ষে এই আপিল খারিজ করা হলো। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে এই রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে  ন্যস্ত রইলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
গতবছরের ৫ মে হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ওই রায়ের ফলে সংসদের বিচারক অপসারণ ক্ষমতা বাতিল হয়ে যায়। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। আপিলে সরকার ও রিটকারী পক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাসকিউরিদের মতামত নেয় আপিল বিভাগ। দীর্ঘ আপিল শুনানিতে দশজন অ্যামিকাসকিউরির মধ্যে নয়জনই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দেন। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে গত পহেলা জুন আপিল বিভাগ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। গত ৯ জুন থেকে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরু হয়। ২২ দিনের অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্ট খোলার পরেই সরকারের আপিল রায় ঘোষণার জন্য কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। দেশের শীর্ষ আইনজীবীরা এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলো এ সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করে। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে এই রিট আবেদন দায়ের করেন। হাইকোর্ট এই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করে। ২০১৫ সালের ২১ মে রুলের উপর চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়।
হাইকোর্টের মূল রায়ে বলা হয়, আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো বড় দলগুলোর মধ্যে বিভেদ এবং সমাজ মারাত্মকভাবে বিভক্ত। এছাড়া সংসদে সবসময় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে। ফলে একজন বিচারক অদক্ষ হলেও অপসারণ করা যাবে না। তাহলে তা দেশের জন্য লজ্জাজনক হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আদালত চোখ বন্ধ করে রাখতে পারে না। আদালত বলেন, বাংলাদেশে বিচারক নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। কিন্তু অপসারণের নীতিমালা করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই ঠিক নয়। আগে নিয়োগের নীতিমালা ঠিক করা উচিত। রায়ে বলা হয়, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে দেওয়ার ফলে বিচার বিভাগের ওপর খড়গ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিচারকদের ওপর যদি এই খড়গ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাহলে জনগণের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। ন্যায়বিচার নিয়ে তখন জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি হবে। জনগণ যদি মনে করেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই তাহলে বিচার বিভাগের অস্তিত্বই থাকে না।
রায়ে বলা হয়, ষোড়শ সংশোধনী আইন-২০১৪ কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে)। এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪) ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লংঘন। রায়ে বলা হয়, এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থি। সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, ওই অনুচ্ছেদের কারণে দলের সংসদ সদস্যরা হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। রায়ে আরো বলা হয়, বিভিন্ন উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আমাদের দেশের সংসদ সদস্যদের দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাঁরা দলের বাইরে যেতে পারেন না। রায়ে বলা হয়, এই সংশোধনী থাকলে বিচারপতিদের সংসদ সদস্যদের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

‘সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে আনা আপিল খারিজ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) আবেদন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আজ সোমবার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এই কথা বলেন তিনি। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে উচ্চ আদালতের রায়ে হতাশ হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন বিচারপতি অপসারণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে এক ধরণের শুন্যতা তৈরি হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে আনা আপিল খারিজ করে দিয়েছে আজ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ এই রায় দেয়।
ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে আনা আপিল খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের কিছু শব্দ বাদ দেয়া হবে বলেও রায়ে বলা হয়। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ বলে দয়া হাইকোর্টের রায়ই বহাল রইল। ফলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা আগের নিয়ম তথা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে হবে। এই রায়কে তিনি ঐতিহাসিক বলে মন্তত্য করেন।
অসদাচারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাকে অপসারণের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’- এর খসড়ার গতবছর ২৫ এপ্রিল মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেয়। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।
বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইন- ২০১৪ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদনটি দায়ের করে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় হতাশ অ্যাটর্নি জেনারেল

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে এ কথা জানান তিনি। মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন ছিল ৭২ এর আদিসংবিধানে ফেরা। কিন্তু এই রায়ের মধ্যে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। এজন্য আমরা দুঃখ ও হতাশা প্রকাশ করছি।’  উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের আনীত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল তা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।  আজ সকাল সাড়ে ১০ টায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ঐক্যমতের ভিত্তিতে সরকারের আপিল খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগ বলেছে, হাইকোর্ট রায়ের যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, সেই পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার সাপেক্ষে এই আপিল খারিজ করা হলো।  এই রায়ের ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত রইল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

ভ্রাম্যমাণ আদালত : হাইকোর্টের রায় আরও দুই সপ্তাহ স্থগিত

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল কোর্ট) আদালত পরিচালনা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় আরও দুই সপ্তাহ স্থগিত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার এ আদেশ দেয়। ফলে আরও দুই সপ্তাহ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা চলতে বাধা নেই বলে জানায় আইনজীবীরা। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল কোর্ট) আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত ২০০৯ সালের আইনের ১৪ টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে গত ১১ মে রায় দেয় হাইকোর্ট। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে এ আদেশ স্থগিত করে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট আদালত বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রেরণের আদেশ দেয়। পরে গত ২১ মে আপিল বিভাগের আদেশে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের কার্যকারিতা ২ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের রায় প্রকাশ হলে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপিল করারও নির্দেশ দেয়া হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল কোর্ট) আদালত পরিচালনা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৭ জুন প্রকাশ করা হয়েছে।  রায় প্রদানকারী বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশিষ রঞ্জন দাসের স্বাক্ষরের পর এ রায় প্রকাশ করা হয়। ৬৪ পৃষ্ঠায় দেয়া এ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল কোর্ট) আদালতে সাজাপ্রাপ্ত পৃথক তিন ব্যক্তির দায়ের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে গত ১১ মে রায় দেয় হাইকোর্ট বিভাগ।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn