বার্তা ডেস্ক : সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্যগুদাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে কালোবাজারি চক্রের সাড়ে ৬ লাখ টাকার সমপরিমাণ মূল্যের ট্রাক বোঝাই ২০ টন চালসহ দু’জনকে আটক করা হয়। গত সোমবার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ট্রাক বোঝাই চালসহ দু’জনকে আটকের ঘটনায় জেলা শহরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনা জানাজানি হলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, কালোবাজারি এমনকি খাদ্যগুদামে থাকা সংশ্লিষ্টরা নিজেদের অপকর্ম ঢেকে রাখতে শুধু ট্রাক ড্রাইভারকেই মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। সুনামগঞ্জে নতুন করে আরেক জজমিয়া নাটকের সূত্রপাত শুরু হয়েছে বলে জেলাব্যাপী নানা শ্রেণী-পেশার লোকজনের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। জানা গেছে, সোমবার বিকালে ট্রাক বোঝাই চালসহ দু’জনকে আটকের ঘটনায় রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় লক্ষ্মীপুরের রামগড় উপজেলার হরিচ্চর দরগাবাড়ি গ্রামের আবুল কালামের ছেলে হতদরিদ্র ট্রাক ড্রাইভার শাহাদতকে (২৮)। সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা নং-২০, তারিখ ১৭.০৬.১৯, ধারা ৪০৬/৪২০/১৯০ (প্রতারণা বা বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ)। জব্দকৃত ট্রাক (যাহার নং-ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৮৩৯১)। মামলায় ‘সুনামগঞ্জের স্থানীয় এক অটোরাইস মিলের নামে লেখা সংবলিত’ জব্দকৃত চালের বস্তায় চালের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২০ টন (৬০০ বস্তা প্রতিটিতে ৩০ কেজি করে)। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

মঙ্গলবার মামলার এজাহার ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাহুল চন্দ বিশেষ তল্লাশিকালে সোমবার বিকালে জেলা খাদ্যগুদামের ভেতর থেকে চাল বোঝাই ট্রাক বের হওয়ার পর ওই ট্রাকটি পার্শ্ববর্তী রাসেল রাইস মিলের প্রবেশমুখে থামিয়ে ড্রাইভারের কাছে চালের চালানপত্র দেখতে চান। ড্রাইভার কোনো প্রকার চালানপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে নিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে প্রথমে কাউকেই খুঁজে না পেলেও কিছুক্ষণ পর এ কক্ষে উপস্থিত সুনীল চন্দ্র সরকারকে ড্রাইভার শনাক্ত করেন এবং বলেন এই সুনীল চন্দ্র সরকার মল্লিকপুর খাদ্যগুদাম এবং গুদাম পার্শ্ববর্তী রাসেল অটো রাইস মিলে চাল পরিবহনের জন্য ট্রাকটি ভাড়া করেছেন। এরপর খাদ্যগুদামে লোকজন জড়ো হলে জনসম্মুখে জিজ্ঞাসাবাদে ড্রাইভার জানান, তিনি ১৬ জুন রোববার বেলা ৩টায় ট্রাকটি নিয়ে সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর সরকারি খাদ্যগুদামে প্রবেশ করেন। এ ট্রাকে করেই আশুগঞ্জের স্থানীয় একটি মিল থেকে চালগুলো নিয়ে আসা হয়। ট্রাকে থাকা চাল অর্ধেক খাদ্যগুদামে আনলোড করার কথা এবং বাকি অর্ধেক চাল পার্শ্ববর্তী রাসেল অটোরাইস মিলে আনলোড হওয়ার কথা ছিল। পরে জেলা প্রশাসন থেকে চাল বোঝাই ট্রাক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের হেফাজতে ও ড্রাইভারকে পুলিশ হেফাজতে হস্তান্তর করে একটি লিখিত নির্দেশনায় আটক ড্রাইভার, ট্রাক ভাড়া নেয়া সেই সুনীল সরকার, অটোরাইস মিল মালিক এবং অনৈতিক সুবিধাভোগী কালোবাজারিদের চাল বোঝাই ট্রাক গুদামে প্রবেশ ও সহায়তাকারীদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।

কিন্তু জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কালোবাজারি চক্র ও নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে বিকাল থেকে মধ্যরাত অবধি নানা নাটকীয়তার পর গভীর রাতে শুধু ড্রাইভারকে আসামি করে থানায় একটি ফরমায়েশি মামলা দায়ের করান। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণে চিহ্নিত হওয়া সেই রাসেল অটোরাইস মিল মালিক, ট্রাক ভাড়াকারী সুনীল সরকার, খাদ্যগুদামে থাকা নিজ দফতরের সুবিধাভোগীদের নাম মামলার এজাহারে রাখা হয়নি। জানা গেছে, জব্দকৃত চাল ও সেই অটোরাইস মিলের মালিক সুনামগঞ্জ শহরের হাজিপাড়ার ব্যবসায়ী রাসেল আহমদ। তার বাবা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম। চাল জব্দ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অটোরাইস মিল মালিক রাসেল গণমাধ্যমকে বলেন, রাইস মিলের এ চাল পরিষ্কার করার জন্য আশুগঞ্জে একটি মিলে পাঠানো হয়েছিল। আশুগঞ্জ থেকে পরিষ্কার করে ফিরিয়ে আনার পর খাদ্যগুদাম চত্বরে ট্রাক রাখা হয়েছিল কিন্তু চাল আশুগঞ্জ থেকে কেনা হয়নি।

মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. শহীদুল্লাহ বললেন, অতীতে কালোবাজারি চক্রের চাল আটকের পর যেসব ধারায় মামলা হয়েছে এ মামলায় সেসব গুরুত্বপূর্ণ ধারার উপস্থিতি নেই। মামলার এজাহার যেভাবে দেয়া হয়েছে, সেটি সম্পর্কে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতর ভালো বলতে পারবেন। সোমবার ঘটনার পর এমনকি মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মোস্তফা গণমাধ্যমকে চাল আটকের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ভুয়া বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা করতে থাকেন। সোমবার রাতে তিনি যুগান্তরকে জানান, এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলে বলা যাবে আসল ঘটনা কী? মঙ্গলবার দুপুরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নানাভাবে তথ্য দিতে গড়িমসি করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন, এ চাল গুদামে প্রবেশ ও বাহিরে যাওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই গুদামের ভেতরই খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতরের কেউ না কেউ তো জড়িত আছেই। চাল আটকের পর যে যে ধারায় মামলা হওয়ার কথা সেসব ধারায় মামলা না দিয়ে আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে কি না।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই আমার অফিসের লোকজন যেভাবে বলেছে আমি সেভাবেই মামলা করার জন্য সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুর রউফকে বলেছি। তিনি যুগান্তরের এ প্রতিবেদককে পরামর্শ দেন, আপনি আপাতত মামলা অনুযায়ী সংবাদ লেখেন। পরে আপনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতে কথা হবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। স্থানীয় কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ খাদ্যগুদামে দেয়ার জন্য চাল বাইরে থেকে আনা হয়ে থাকলে সেটি দুঃখজনক হবে। বিষয়টির ওপর নজরদারি করছে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সূত্র : দৈনিক যুগান্তর

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn