তাঁদের সংসারজীবন ৫০ পেরিয়ে ৫১ বছরে পা দিয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন গীতা চক্রবর্তীকে। বর দুলাল চক্রবর্তীর বয়সই বা কত! ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করে সবে শুরু করেছিলেন চাকরি। ১৯৬৭ সালের ২৮ এপ্রিল বিয়ে হয় এই দম্পতির। ওই দীর্ঘজীবনে গীতা একবেলাও ভাত খাননি স্বামীকে ছাড়া। লিখেছেন : তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার কিশোরী গীতা পাঠশালার মাটিতে পা রাখেননি। পৈতৃক বাড়িতে কেবল পড়েছিলেন বাল্যশিক্ষার অ-আ। নিজের নাম লিখতে পারেন ভালো মতো। পড়তেও পারেন। সুশিক্ষার কোনো কমতি নেই। স্বামীর ঘরে গেলে কী করতে হবে-সেই প্রথম শিক্ষাটি তিনি এখনো কামড়ে ধরে আছেন। মা আর ঠাকুরমা দিয়েছিলেন সেই অমর শিক্ষা। তা হলো, ‘স্বামীর আগে কোনোদিন ভাত খেতে নেই। ’ ওই শিক্ষা নিয়েই গীতা দাম্পত্য জীবনে স্বামীর আগে খাবার খাননি কোনোদিন। এই রেওয়াজ পালন নিয়ে তাঁর গর্বেরও কমতি নেই। জানালেন, বিয়ের প্রথম দিকে স্বামী ঘরে ফিরতে দেরি হলে ভীষণ ক্ষুধা পেত।

মাঝে মাঝে ক্ষুধার জ্বালা হতো অসহ্য। তখন খেয়ে নিতে ইচ্ছা হলেও মনে পড়ত মা ও ঠাকুরমার অমর বাণীটির কথা। তাঁরা উপদেশ দিয়েছিলেন, ঘরে স্বামী আসার আগে যে স্ত্রী ভাত খেয়ে নেয় তার কপালে বড় দুঃখ আছে। স্বামীর আগে খাবার খেলে সেই পরিবারে ভর করে অলক্ষুণে।

গীতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমার বাচ্চারা দুগ্ধপোষ্য থাকতে শাশুড়ি বলতেন, ‘দুলাল ঘরে ফিরতে দেরি হবে। তুমি ভাত খেয়ে নাও। সকাল সকাল ভাত না খেলে বাচ্চা বুকের দুধ পাবে না। ’ শাশুড়ির সাথে ভাত খাওয়ার মিথ্যা অভিনয় করেছি গ্লাসে গ্লাসে পানি পান করে। শাশুড়িকে সান্ত্বনা দিয়েছি এভাবে। তবু স্বামীর আগে কখনো ভাত মুখে দিইনি। বিয়ের প্রথম প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা বিব্রত হলেও এখন বয়স সন্ধিক্ষণে এসে গা সওয়া হয়ে গেছে। ’’ ‘বিয়ের পর দীর্ঘদিন স্বামীর পরে খেতে বসতাম। পরে পরিমল পাল নামের এক হিতৈষীর অনুরোধে আমরা এক সাথে খেতে বসি। -যোগ করেন গীতা।

কক্সবাজার কেজি স্কুলের শিক্ষক শেলী পাল বলেন, ‘এই দম্পতি সম্পর্কে আমার মামা-মামি। তাঁরা আমার প্রতিবেশীও। মামা বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত না ফিরলেও মামি ততক্ষণ খাবার না খেয়ে অপেক্ষায় থাকার বিষয়টি নিয়ে আমরা ছোটবেলায় হাসাহাসি করতাম। আর এখন মামি আমাদেরকেই তাগিদ দেন তাঁকে অনুসরণ করার জন্য। ’ তিনি জানান, পড়ন্ত বয়সেও অভ্যাস বদলাতে পারেননি মামি। এখনো সাত-সকালে স্নান সেরে পাকঘরে যান। তাও আবার পুরো পাকঘর ধুয়ে মুছেই শুরু করেন রান্না। পুরো ঘর মোছার অভ্যাসও ছাড়েননি। এতে করে রোগব্যাধির জীবাণুমুক্ত থাকে আবাসস্থল।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) হিসেবে ২০০৭ সালে অবসরে যান দুলাল চক্রবর্তী। কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়ার বাসিন্দা দুলাল চক্রবর্তী বর্তমানে সনাতনী সম্প্রদায়ের নানা সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি শহরের ঘোনারপাড়ার কৃঞ্চনান্দধাম মন্দির পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা এবং রামকৃঞ্চ মিশনের সেক্রেটারি।

দাম্পত্য জীবনের অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে স্ত্রীর স্বামীকে ছাড়া ভাত না খাওয়া প্রসঙ্গে দুলাল চক্রবর্তী বলেন, ‘পারিবারিক রেওয়াজটা মা থেকে শুরু করে আমাদের পূর্ববর্তী সময়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করা হয়েছে। তবে এখন ধীরে ধীরে এসব রেওয়াজ থেকে সরে যাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী বিবাহিত জীবনের এ পর্যন্ত এমন কঠোর ব্রত পালন  করে চলেছেন। অথচ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না, আমার উচ্চশিক্ষিত সন্তান এবং কন্যার পরিবার এমন রেওয়াজের ধারে-কাছে আছে কিনা। ’

দুলাল চক্রবর্তী মনে করেন, বাস্তবে সেকালে বুড়ো-বুড়িরা একটি পরিবারকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার জন্যই এরকম রেওয়াজের প্রচলনে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। যেমন স্ত্রীকে স্বামীর আগে খাবার খেতে বারণ করার ক্ষেত্রে জড়িত রয়েছে একটি মানবিক বিষয়। নিশ্চয়ই একজন স্বামী চাইবেন না তার স্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ুক। বেচারি অভুক্ত স্ত্রীর প্রতি মায়ার টানে হলেও একজন লম্পট স্বামীর মন গলে যেতে পারে। স্বামীকে ছাড়া না খাওয়ার রেওয়াজ এভাবেই পারে একজন বিপথগামী স্বামীকেও ঘরমুখো করতে। তখন পরিবারটি সুখী-সমৃদ্ধ হতে বাধ্য।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা এক সাথে অনেক ভাই খেতে বসতাম। মা আমাদের দেওয়ার আগে ডেকচি থেকে একটি প্লেটে রেখে দিতেন কিছু ভাত। এটাকে বলা হত ‘আগ ভাত’। অর্থাৎ ডেকচির আগের ভাত বাবার জন্য নির্ধারিত ছিল। ’ তাঁর মতে, আগে পরিবারের কর্তা-কত্রীর মর্যাদা থাকত আলাদা। এখন কে কোথায় খাচ্ছে-কখন খাচ্ছে-কী খাচ্ছে কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। সময়ের পরিবর্তনে পারস্পরিক এই সম্মানবোধ না থাকায় পরিবার ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

দুলাল-গীতা  দম্পতি কেবল আদর্শ সুখী-সমৃদ্ধ পরিবার নয়। তাঁরা গর্বিত বাবা-মাও। তাঁদের চার ছেলে এবং এক মেয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ছেলে রঞ্জন চক্রবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। ২০০০ সালে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দ্বিতীয় ছেলে অঞ্জন চক্রবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসনে মাস্টার্স করে ব্যাংক এশিয়ায় এভিপি হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর স্ত্রী শিক্ষকতা করেন। তৃতীয় সন্তান কনক চক্রবর্তী বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে কুয়েতে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁর স্ত্রীও শিক্ষক ছিলেন।

এই দম্পতির চতুর্থ সন্তান কংকন চক্রবর্তী কুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্মরত আছেন একটি বেসরকারি কম্পানিতে। তাঁর স্ত্রী বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ডেসকোতে কর্মরত। একমাত্র মেয়ে জবা চক্রবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে ঢাকার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। জবার স্বামী একটি ওষুধ কম্পানিতে রয়েছেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn