হজ ইসলাম  ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা  ফরজ  বা আবশ্যিক। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাৎসরিক তীর্থযাত্রা। যিনি হজ সম্পাদনের জন্য গমন করেন তাঁকে বলা হয় হাজী। অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে মুসলিম বিজয় ও  ইসলাম  প্রচারের পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা হজ পালন করে আসছেন। পনেরো শতকে নূর কুতবে আলম কয়েকবার হজ পালন করেন।  শাহ সুজা আরাকান হয়ে হজের সময় মক্কায় যাবেন এরূপ বাসনা নিয়ে সপরিবারে  ঢাকা  ত্যাগ করেন। হাজী মুহাম্মদ মহসিন মক্কায় হজ্জ পালন করেন। হাজী  শরিয়তুল্লাহও একই উদ্দেশ্যে মক্কা পরিদর্শন করেন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের মুসলি­গণ মুম্বাই হয়ে জাহাজযোগে হজ করতে যেতেন। অনেকে স্বাস্থ্যগত কারণে মুম্বাই থেকেই ফিরে আসতেন;  তাঁদের বলা হতো ‘মুম্বাই হাজী’।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে আল্লাহ-তায়ালার ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ইমারত হচ্ছে মক্কাস্থ পবিত্র কা’বা (৩ঃ৯৬), যা ‘বায়তুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর ঘর’ নামে অভিহিত। আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমকে (আ.) আদেশ দেন: ‘আমার গৃহকে পবিত্র রাখিও তাহাদের জন্য যাহারা তাওয়াফ করে এবং যাহারা সালাত-এ দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করিয়া দাও, উহারা তোমার নিকট আসিবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার দ্রুতগামী উষ্ট্রের পৃষ্ঠে, উহারা আসিবে দূর-দুরান্তরের পথ অতিক্রম করিয়া’ (আল-কুরআন, ২২; ২৬, ২৭)। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম কা’বাকে কেন্দ্র করে হজের প্রবর্তন করেন। তাঁর আহবানে লোকেরা মক্কায় হজ সম্পাদন করার জন্য আসতে থাকে। তখন থেকে  প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কা’বা শরীফে হজ নিমিত্ত সমবেত হতে থাকে।  পরে এক পর্যায়ে কা’বায় ৩৬০টি দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাঁদের এবাদত চলতে থাকে। সেই সঙ্গে নানাবিধ অন্যায় ও অশালীন অনুষ্ঠানও উদ্যাপিত হতে থাকে। এসব কারণে নবম হিজরিতে হযরত মুহাম্মাদ (স.) হজ পালন করতে যাননি; আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে তিনশ সাহাবির একটি দল পাঠানো হয়। দশম হিজরিতে নবী করিম (স.) স্বয়ং হজের নেতৃত্ব দেন। হজ কীভাবে পালন করা উচিত তা তিনি এই হজ্জে নির্দিষ্ট করে দেন।

হজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবস্থাপনায় খামখেয়ালিপনা আমাদের ব্যথিত করে। খবরের কাগজে দেখলাম, ভিসা জটিলতাসহ যাত্রী সংকটের কারণে পবিত্র হজ গমনেচ্ছুদের আজ শুক্রবার সকালের ফ্লাইটটিও বাতিল করেছে বাংলাদেশ বিমান। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অর্ধেক যাত্রীই ভিসা না পাওয়ায় ফ্লাইটটি নাকি বাতিল করতে হয়েছে।  এবছর হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। হজযাত্রীদের জন্য মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি, মোয়াল্লেমের চুক্তি, বাড়িভাড়া, হজযাত্রীর ভিসা ইস্যু ও ভিসাপ্রাপ্ত হজযাত্রীদের বিমানের টিকিট সংগ্রহ না করায় সৃষ্টি হয় এ অবস্থার। এর জন্য ধর্মমন্ত্রী দায়ী করছেন হজ এজেন্সি মালিকদের। অন্যদিকে এজেন্সিগুলো দায়ী করছেন হঠাৎ মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধিকে। অবশ্য একটি পক্ষ ধর্ম মন্ত্রণালয় ও মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতিকে এমন অবস্থার জন্য দায়ী করছে।

জানা গেছে, সৌদি আরবে মোয়াল্লেম ফি ৭২০ টাকার স্থলে ১৫০০ থেকে ১৯০০ রিয়াল নির্ধারণ করায় অনেক হজ এজেন্সি নির্ধারিত সময়ে মোয়াল্লেমের সঙ্গে চুক্তি করেনি। এ ছাড়া ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হজ পালন করেছেন এমন ব্যক্তিদের ২০১৭ সালে হজ পালনের ক্ষেত্রে ভিসার ২ হাজার রিয়াল (৪৪ হাজার টাকা) ধার্য করায় অনেকে তা পরিশোধে রাজি হননি। ফলে ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান এজেন্সি মালিকরা।

হজ অফিসের তথ্য অনুযায়ী,  ২০১৭ সালে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ বাংলাদেশি হজ পালনের সুযোগ পাবেন। গতকাল পর্যন্ত ভিসা পেয়েছেন ৫৬ হাজার। ভিসাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩২ হাজার ৫০৪ জন সৌদি আরবে গেছেন; বাকি ২৩ হাজার ৪৯৬ জনের যাওয়ার অপেক্ষা। ২৪ জুলাই ফ্লাইট শুরুর পর হজযাত্রী না পাওয়ায় ২৯ জুলাই থেকে ফ্লাইট বাতিল শুরু হয়। অবশ্য হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বিপর্যয় নিয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় অবস্থান তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। কিন্তু সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।

এবারে একটু পেছনের দিকে তাকাই। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে যখন রাজকীয় সৌদি সরকার দ্বিতীয়বারের হজ ও ওমরা যাত্রীর ভিসা নিতে ২ হাজার নির্ধারণ করে, বিষয়টি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদের তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সৌদি আরবের মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের কাউন্সেলরকে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর চিঠি দেয় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিযুক্ত আইটি প্রতিষ্ঠান বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় জেদ্দার কনসাল জেনারেল, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আশকোনার হজ অফিসের পরিচালককে। কিন্তু চিঠি দেওয়ার পর মক্কার কাউন্সেলর অফিস বা ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয়বারের হজযাত্রীর ভিসা গ্রহণে যে অতিরিক্ত ২ হাজার রিয়াল ধার্য করা হয়, তা নিশ্চিত হওয়া যেত। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে হয়তো ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা এড়ানো সম্ভব হতো। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের হজ পালনকারীদের ২০১৭ সালে হজ পালনের ক্ষেত্রে ভিসা ইস্যু নিয়ে যে জটিলতা, এর পেছনে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতি রয়েছে।

পত্রিকা মারফত জেনেছি, ২০১৭ সালের হজ পালনের জন্য যেসব বাংলাদেশি সৌদি আরব যাবেন, তাদের ভিসা ইস্যুর জন্য পাসপোর্ট নেওয়া হবে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত। বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীদের পাসপোর্টে মোয়াল্লেম নম্বর ও মক্কা-মদিনার বাড়ির ঠিকানাসংবলিত স্টিকার না থাকায় জেদ্দা বিমানবন্দরে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি হজযাত্রী। এ জন্য স্টিকার লাগিয়ে হজযাত্রীদের ফ্লাইট ধরতে জেদ্দা হজ অফিস থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। ওই চিঠি পাওয়ার পরই ২৮ জুলাই ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীদের পাসপোর্টে মোয়াল্লেম নম্বর ও মক্কা-মদিনার বাড়ি বা হোটেলের নাম ও তাসরিয়া নম্বরসংবলিত স্টিকার সংযুক্ত করে হজযাত্রীকে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আর  স্টিকার সংযুক্ত না করে হজযাত্রীদের সৌদি আরব পাঠানো হচ্ছে। ফলে জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে বাসযোগে মক্কা ও মদিনায় পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে। হজযাত্রীদের দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এটি হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। আশা করি হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn