আরিফুর রহমান-

রমজানের চাঁদ বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপর পড়ে রাতের হাওরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এক বছর আগে গ্রীষ্মের এই সময়ে গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট আড্ডা চলত হাওরাঞ্চলের হাট-বাজার আর রাস্তার ধারে। ফসল উঠে যায় এ সময়টায়। কৃষকের ঘরে থাকে গোলাভরা ধান, গোয়ালে গরু। এ সময়টা আয়াশে কাটিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও এ বছরের চিত্র ভিন্ন। অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল হাওরাঞ্চলের কৃষকের বোরো ধান ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।

জীবিকার সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়েছে অনেকে। গোখাদ্যের অভাবে এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি করে দিয়েছে কৃষক। বিকল্প আয়ের সন্ধানে বড়দের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়ারাও ঘুরছে। এতে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বিপাকে পড়া হাওরাঞ্চলের এসব মানুষের সহায়তায় সরকার এগিয়ে এলেও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে সেটাও ফলপ্রসূ হচ্ছে না। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

এ বছর অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরবেষ্টিত সাতটি জেলায় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। সাতটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জে। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এ বছর জেলার ১৫৪টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে এক লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন লাখেরও বেশি মানুষ; যদিও স্থানীয় লোকজনের দাবি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।

সুনামগঞ্জ সদর, দিরাই ও শাল্লা উপজেলা ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হাওরাঞ্চলের মানুষ বোরো ধানের ওপরই নির্ভরশীল। এপ্রিলের মধ্যে ধান কাটা শেষ করে ফেলে মানুষ। বর্ষায় বিকল্প কোনো কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাতে হয় হাওরাঞ্চলের মানুষদের। কিন্তু এ বছর ২৭ মার্চ অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় জেলার সব হাওর। পানির নিচে তলিয়ে যায় কৃষকের কাঁচা ও আধাপাকা ধান।

গত বছরের এই সময়ে ঈদের প্রস্তুতি ছিল হাওরজুড়ে। কিন্তু এবার খাবার জোটা নিয়েই যেখানে সংশয়, সেখানে ঈদের জামাকাপড় কেনা হাওরাঞ্চলের মানুষের কাছে বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় শপিং মল ও বিপণিবিতানগুলোতে যেখানে কেনাকাটার ভিড় বাড়ছে, সেখানে ব্যতিক্রম হাওরাঞ্চল।

দিরাই উপজেলার আলোর দিশারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে তামান্না আক্তার। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার বড়। পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে সে বলে, ‘পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ধাক্কা এসেছে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পরীক্ষায়। ’ ঈদের কেনাকাটার প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে তামান্নার চোখ থেকে টলটল করে পানি ঝরল। সামলে নিয়ে বলল, ‘তিন বেলা খেতেই যেখানে কষ্ট হচ্ছে, জামা কিনব কিভাবে। ’ গত বছরের স্মৃতিচারণা করে সে বলে, ‘৭৫০ টাকা দিয়ে একটি পাখি জামা কিনেছিলাম গত বছর। ভাইদের জন্য বাবা শার্ট ও পাঞ্জাবি কিনেছিল। ’

তামান্না যখন কথা বলছিল, পাশেই বসে ছিলেন তার বাবা মোহাম্মদ শাজাহান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর নিজের স্ত্রীর জন্য এক হাজার ১৫০ টাকা দিয়ে একটি শাড়ি কিনেছিলেন। এ বছর স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ঈদের জামাকাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। জীবিকার সন্ধানে তাঁর দুই ভাই শাহ কামাল ও আবুল খায়ের এরই মধ্যে ঢাকায় পাড়ি দিয়েছেন।

আবদুল মালেকের বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায়। অতিবৃষ্টিতে অন্য সবার মতো তাঁরও মাঠের ফসল সব তলিয়ে গেছে। জীবনধারণের কথা ভেবে অন্ধকার দেখছেন আবদুল মালেক। অবশেষে এলাকা ছেড়ে দিরাই উপজেলায় এসে এখন ভাঙারি ব্যবসা শুরু করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আর কোনো কাজ পাচ্ছি না। তাই ভাঙারি ব্যবসা শুরু করেছি। ’

অতিবৃষ্টির কারণে ফসলহানি হওয়ায় হাওরাঞ্চলের ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান সরমঙ্গল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী। তিনি জানান, তাঁর নিজের সাতটি গরু ছিল। সেগুলো পানির দামে বিক্রি করে দিয়েছেন।

প্রয়াত বাউল শাহ আবদুল করিমের বাড়ি দিরাই উপজেলায়। আবদুল করিমের ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘গাড়ি চলে না’—এসব জনপ্রিয় গান হাওরাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বর্ষার সময় বিভিন্ন গানের আসরে এসব গান গেয়ে আর শুনে সময় কাটে হাওরাঞ্চলের কৃষকের। শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূরজালাল করিমও একজন বাউলশিল্পী। প্রতিবছর বোরো ধান উঠে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় গানের আসরে আমন্ত্রিত হয়ে যান তিনি। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কোথাও আমন্ত্রণ পাননি তিনি। আবদুল করিমের নাতি দুখু মিয়াও গানের আসর জমিয়ে তুলতেন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত কোথাও যাওয়ার আমন্ত্রণ নেই তাঁরও।

জানতে চাইলে শাহ নূরজালাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষের হাতে টাকা নেই। খাওয়ার চাল নেই। মানুষ যেখানে খেতেই পারে না, সেখানে গানের আসর বসানোর চিন্তাই তো করা যায় না। অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল হাওরাঞ্চলের মানুষকে অনেক ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিল। ’

এ তো গেল সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। সামাজিক পরিবর্তনও এসেছে দুর্যোগের কারণে। বোরো ধান উঠে যাওয়ার পর রমজানে প্রতিদিন মসজিদে ইফতার মাহফিল করার রেওয়াজ রয়েছে সুনামগঞ্জে। একেক দিন একেকজন উদ্যোগী হয়ে এ মাহফিল করতেন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত ইফতার মাহফিল আয়োজন হয়নি। জানতে চাইলে সরমঙ্গল ইউনিয়নের আলোর দিশারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সমাজে রমজানের সময় ইফতারের আয়োজন করা হতো। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। ’

হাওরাঞ্চলে ব্যাপক ফসলহানির পর সরকার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি কৃষক পরিবারকে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু চাল ও টাকা বিতরণে ব্যাপক স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। তাড়ল ইউনিয়নের শাহাবুদ্দিন, দুলু মিয়া, গফুর মিয়া, নুরুল ইসলাম, সানাফ মিয়া, মোহাম্মদ বাকি বিল্লাহসহ অনেকে এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছে, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বার নিজেদের পছন্দমতো লোকজনকে চাল ও টাকা বিতরণ করেছেন। সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সরকারের দেওয়া চাল ও টাকা পাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। সেসব অভিযোগ সমাধান করা হয়েছে। যারা সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের চাল ও টাকা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘যতসংখ্যক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার তুলনায় সহায়তা অনেক কম। সুনামগঞ্জে ভিজিএফ (দুস্থদের খাদ্য সহায়তা) কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে দেড় লাখ ক্ষতিগ্রস্তকে। আরো এক লাখ মানুষকে ভিজিএফ সহায়তা দিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার জবাব আসেনি। এ ছাড়া ১১০টি স্থানে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি হচ্ছে। এটাকে বাড়িয়ে ২১১টি খোলাবাজারে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও সে চিঠির জবাব এখনো আসেনি। ’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn