চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। জোট সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা হাওয়া ভবনের নিয়ন্ত্রণকর্তাদের একজন তিনি। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর ‘হাওয়া’ হয়ে যান হাওয়া ভবনের শক্তিধর এই নেতা। এরপর তার উধাও রহস্য নিয়ে নানা কথা ভেসেছে বাতাসে। কখনো ভারত, কখনো ইরান আবার কখনো যুক্তরাজ্যে তার অবস্থানের কথা শোনা গেছে। কিন্তু তার সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেননি কেউই।
তবে বর্তমানে হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে তার স্বজনদের থেকে। সেখানে পরিবারের সঙ্গেই আছেন তিনি। করোনা আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয় বলে সূত্র নিশ্চিত করেছেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছেন, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন এবং সেখানেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
সোমবার (১৬ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে সিলেট বিএনপি ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা ফেসবুকে হারিছ চৌধুরীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে তার জন্য দোয়া চান। এর পর থেকে সিলেটজুড়ে ফের আলোচনায় আসেন হারিছ চৌধুরী। তবে যারাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দোয়া চেয়েছেন তাদের কেউই হারিছ চৌধুরীর অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেননি।
এ স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে একটি গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, সোমবার যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তার এক চাচাতো ভাই ফেসবুকে অসুস্থতার খবর জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন। এ স্ট্যাটাস দেখে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত হারিছ চৌধুরীর মেয়ে মুন্নু চৌধুরীকে ফোন দেন। মুন্নু তার বাবার অসুস্থতার খবর নিশ্চিত করে জানান, তার (হারিছ চৌধুরীর) ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে তিনি বাসায় আছেন।
আশিক চৌধুরী জানান, উধাও হয়ে যাওয়ার পর থেকে হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে তাদের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। বর্তমানে হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী ও মেয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ছেলে জনি চৌধুরী নরওয়ের একটি তেল কম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।
হারিছ চৌধুরীর শারীরিক অবস্থা খারাপ ও তিনি করোনা আক্রান্ত- এমনটা শুনেছেন বলে জানিয়েছেন জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক ইকবাল আহমদ। তিনি হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তিনি জানান, লোকমুখে তিনি শুনেছেন হারিছ চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ। তার করোনা হয়েছে।
হারিছ চৌধুরীর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। হারিছ চৌধুরী উধাও হওয়ার পর তারা আর দেশে ফেরেননি। সূত্র জানান, হারিছ চৌধুরী তার পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। কয়েকদিন আগে তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বাসায় নিয়ে আসা হয়। তবে তার ফুসফুসে সংক্রমণ রয়েছে। করোনা ছাড়াও বার্ধক্যজনিত নানা রোগে তিনি ভুগছেন। তিনি আগেই ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। সর্বশেষ ২০০২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রক্ত পরিবর্তন করে আসেন। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আরেকবার তিনি রক্ত পরিবর্তন করিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
এদিকে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, হারিছ চৌধুরী পাশের দেশ ভারতের আসামের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে মামাবাড়িতেই আছেন। সেখান থেকে তিনি ব্যবসা করছেন। কয়েকদিন আগে সেখানেই করোনা আক্রান্ত হন। এরপর রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দু-তিন দিন পর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার ফুসফুসে সংক্রমণ রয়েছে। তার চিকিৎসার দেখভাল করছেন এক ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি আগেই করোনার দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
কবে ছাড়েন দেশ : ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির সপ্তাহখানেক পর সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে বেড়াতে আসেন হারিছ চৌধুরী। ওইদিন বাড়ির পাশের জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজারস্থ ইছামতি টাইটেল মাদরাসায় তিনি বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষে তিনি বাড়ি ফিরে যান। রাত ১২টার পর তার ব্যক্তিগত সহকারী আতিক মোবাইল ফোনে ঢাকায় বিএনপি নেতাদের বাসায় যৌথ বাহিনীর অভিযানের কথা জানান। এ খবর পেয়ে হারিছ চৌধুরী সস্ত্রীক সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন। এর কয়েক ঘণ্টা পর যৌথবাহিনী তার বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে পায়নি। এরপর কয়েক দিন সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে ২৯ জানুয়ারি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে ভারতে পালিয়ে যান বিএনপি সরকারের দাপুটে এই নীতিনির্ধারক। এরপর তিনি ওঠেন নানাবাড়ি করিমগঞ্জের বদরপুরে। এরপর পাকিস্তান হয়ে ইরানে তার ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে পৌঁছান এমন খবরও চাউর হয়। ইরানে কয়েক বছর থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে পরিবারের কাছে যান। সেখান থেকে ভারতে যাতায়াত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভাল করতেন বলে একাধিক সূত্র বিভিন্ন সময় নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজা হয় হারিছ চৌধুরীর। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীর সাত বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। এ ছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১০৪ বার