২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত আজ জাতীয় সংসদে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ শ্লোগান সম্বলিত এ বাজেট পেশ করেন। বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া, এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ০.৪ শতাংশ। কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৪ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১০.৮ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬.৯ শতাংশ এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের বরাদ্দ ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এর ফলে এডিপির মোট আকার হলো ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৭.৪ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২.৩ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ২.৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৩ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।এর আগে আজ দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপরই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করেন। এছাড়াও অর্থমন্ত্রী আজ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের চতুর্থ বাজেট। এছাড়া গত বছরের মতো এবারও সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতিতে বাজেট পেশ করা হলো।

প্রস্তাবিত বাজেটের উন্নয়নের লক্ষ্য ও কৌশল হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন। আর রূপকল্পের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কৌশল হচ্ছে উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন, পণ্যদ্রব্য ও সেবার যোগান বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারের সাথে ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়া, উৎপাদন বিশেষায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা।

অর্থমন্ত্রী বেলা ১টা ৩৬ মিনিটে বাজেট বক্তৃতার শুরুতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার জাতীয় নেতা, মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্র ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী শহীদ, ’৭৫-এর কালোরাত্রিতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার বঙ্গবন্ধুর নিষ্পাপ স্বজন এবং অন্যান্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সাথে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদে রাষ্ট্রপতির গ্যালারিতে বসে বাজেট বক্তৃতা শোনেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ বিভিন্ন বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্ট আমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারাও সংসদ ভবনে উপস্থিত থেকে বাজেট বক্তৃতা শোনেন।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, বিগত ৮ বছর সরকারের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে আঘাত এসেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে সহিংস সন্ত্রাসের দ্বারা ব্যাপকভাবে সম্পদ ধ্বংস এবং জীবনহানি ঘটানো হয়েছে। অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমার সাহায্যে মানুষ পোড়ানোর মতো জঘন্য ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়েছে। অশুভ তৎপরতার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। মৌলবাদি শক্তিকে উসকে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববাসীর নিকট বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার সব ধরনের অপচেষ্টাই চালানো হয়েছে।

তিনি বলেন, কিন্তু কুচক্রী মহলের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বেও বিস্ময়রূপে অটল হিমালয়ের মতো চির উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, কর্মসৃজন, খাদ্য উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমদানি ও রপ্তানি- এরূপ কোন সূচকেই বর্তমান সরকার আর পিছিয়ে নেই। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে। দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসসহ আর্থ-সামাজিক খাতের প্রায় প্রতিটি সূচকেই সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য রয়েছে।

তিনি বাজেট বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন ও অভূতপূর্ব উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায় অনেকটা পথ এগুলেও আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। বিশেষ করে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে উৎপাদনের উপকরণ পুঞ্জিভূতকরণের পাশাপাশি এগুলোর উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। কার্যকর মানব-মূলধন মজুদ গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনিক সংস্কারও বাস্তবায়ন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যক্তিখাত বিকাশের পথ কন্টকমুক্ত রাখতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় গত ৮ বছরে বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চিত্র বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। বিশেষ করে গত ৮ বছরে মন্দা মোকাবেলায় সাফল্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রবাসী কল্যাণ, নারী ও শিশু, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও জনশক্তি রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকার পুনর্গঠন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, কর্মসংস্থানসহ সকল ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের বর্ণনা করেন।

এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে মোট বরাদ্দের ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, যার মধ্যে মানব সম্পদ খাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট খাতে ২৬.১২ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩১.৭৪ শতাংশ- যার মধ্যে রয়েছে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৩.০২ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ১১.৮৮ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫.২৮ শতাংশ।

এছাড়া সাধারণ সেবা খাতে ২৪.০৩ শতাংশ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ ১.৮৮ শতাংশ। এছাড়া সুদ পরিশোধ বাবদ ১০.৩৬ শতাংশ। নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে অবশিষ্ট ২.৬৮ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn