আশিন আমরিয়া:: প্রাজ্ঞ, বিচক্ষন, প্রতিভাশালী মানুষদের পারিবারিক অন্তে শুধু ভাবা যায় না। জ্ঞানি, গুণি, দূরদর্শী, মানুষজনকে আত্মীয়তার গন্ডিতে বিবেচনা করা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ভাবনা হতে পারে না। তাঁরা পরম্পরায় সকলের। সকল তাঁদের। মহিমা গৌরবের বেড়াজাল ভেঙ্গে সংবেদ্য উপলব্ধীর দৃঢ়তায়, তাঁরা মানুষের আত্মার মধ্যমণি হয়ে যান। নিরূপিত স্বভাব চরিত্রের গুণগত বৈশিষ্ট প্রতিপালন করে, বিশ্বাস অনুরাগে মানুষের আনুগত্য আদায় করে তাঁরা হয়ে যান নেতা, মোহানেতা। মুক্ত বিহঙ্গের মত সীমানাপ্রাচির ভেঙ্গে সকল পরিসরে তাঁরা বিচরন করেন, সাম্য সমপ্রীতির ব্যক্তি বিশেষণে। সমাজ বসতির মানব সম্প্রদায়ের পথ প্রদর্শক আলোকবর্তিকা হয়ে আলোকিত করেন গোত্রিয় অধিশ্রয়। এ রকম কোন মর্যাদাসম্পন্ন জীবনচরিত লেখনির মাধ্যমে উপস্থাপন করা খুবই কঠিন। শব্দসমষ্টির নির্বরতা দিয়ে তাঁদের মহত কৃতসাধনার ক্ষুদ্রাংশ প্রকাশ করা দুস্কর। যে প্রতিমুর্তির সংক্ষিপ্ত খ্যাতি আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য হিসাবে বেছে নিয়েছি তিনি হলেন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া নিবাসি বিশিষ্ট সমাজ সেবক, সংস্কারক, প্রখর মানবতাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, মরহুম জ্বনাব আব্দুস্ সালাম সাহেব (আনকন্টেস্ট ইউ পি চেয়ারম্যান)

নেবেদিত প্রান “জবনাব আব্দুস সালাম সাহেব”র মানব কল্যাণে উদাহরনযোগ্য একটি বিরল ঘটনা। চোয়াত্তরের বন্যাকবলিত সারা গ্রাম, চারিদিকে থইথই পানি আর পানি। ঘরবন্দি আথঙ্কগ্রস্থ অসহায় মানুষ। খাদ্যাভাবের মতো চরম দুর্দিনের হাতছানি। সে সময়, পরম মমতায় মানুষের মাথার উপর অশ্বত্থের সুশীতল ছায়া হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধেয়ে আসা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় পতিত শ্রমজীবীদের, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বার লক্ষ টাকার মতো অনুদান, সহায়তা দিয়ে ছিলেন। যে টাকার ভেলিউ ছিলো, সিলেট দরগামহল্লার মতো দুর্লভ জাগার মূল্যমাণে পচিশ থেকে ত্রিশ বিঘা জমির দাম, হয়তো বা আর বেশি! এর এক বছর আগে দরগামহল্লায় একুশ শতক বাসার জাগা রেখেছিলেন, উনিশ হাজার টাকা দিয়ে। যেমন ছিলো বিশাল হৃদয়! দেখতে ও ছিলেন রাজপুতের মতো। বর্ণীল জীবনে, প্রাচুর্যের অহমিকা যাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। মহত মহানভব, “সালাম সাহেব” সম্পদের পাহাড় না গড়ে, অন্তরের মমত্ব, উদারতা দিয়ে মানব সেবায় ভালোবাসা সন্মান কুড়িয়েছেন। যার প্রতিদান পেয়েছেন মৃত্যুর পর, এলাকার মানুষের ভালোবাসার পুঞ্জিভূত ক্ষুভে নতিস্বীকার করে “সালাম সাহবের” নিতরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বিদেশ-বিভূঁই লন্ডনেও সমধিক পরিচিত, মরহুম আব্দুস্ সালাম সাহেব চাইলে তখন এমপি হতে পারতেন। তেমন যোগ্যতাও ছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ইউ পি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া ছিলো উনার বিশাল ব্যক্তিত্বের ক্ষুদ্রতম অর্জন। উনাকে এর দুই টার্ম আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এলাকাবসীর পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার অনুরুধ করা হয়ে ছিল, তিনি লন্ডন পালিয়ে যেয়ে মতামত জানিয়ে ছিলেন, জরুরি প্রয়োজনে লন্ডন চলে আসতে হয়েছে, তাই আপনাদের কথা রক্ষা করতে পারলাম না বলে আমি দু:খিত।

পদ-পদ্ববীতে অনাগ্রহ দেখানোর মত দৃষ্ঠতা যার চিন্তা চেতনায় ছিল, এমন বিরল ব্যক্তিত্বকে কি বলতে পারি! “অতিমানব” ? সংসয় ঝেড়েই বলছি যোগ্য মানুষদের দ্বারাই নেত্রীত্বের প্রস্থাব অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা বা হিম্মত রাখা সম্ভব।যেখানে নেত্রীত্বের জন্য অযোগ্যরা ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রেরন্যায় লুলোপ দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে, সেখানে যোগ্যরা হন আহত, লজ্জিত। “সালাম সাহেব” ইলেকশন করার জনপ্রস্থাবে লজ্জিতই হয়ে ছিলেন বটে। অবশ্য পরেরবার এলাকাবাসীর প্রস্থাব থেকে উনাকে পালাবার আর কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।

তিনি চেয়াম্যান নির্বাচিত হবার পর, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের চলাচল ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে প্রথমই ছয়হাড়া থেকে আমরিয়ার রাস্তাটির প্রতি গুরুত্ত আরূপ করেন। যার সুফল আজ আমরা ভূগ করছি। যে রাস্তার জন্য, আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে “সালাম সাহেব”কে মস্তবড় এক যুদ্ধ করতে হয়েছে। যে যুদ্ধ ছিল ক্ষুরুক্ষেত্রের চেয়েও কঠিন, বিশাল। এ রাস্তাটিকে মহাসড়কে রুপান্তরের চেষ্টায় সে সময় উনার অনেক যক্ষি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। গত তেতাল্লিশ বছরে রাস্তাটি কয়েকবার সংস্কার হয়েছে। এ রাস্তাটি আমাদের এক প্রজন্মের স্বপ্ন ছিল।

অবশেষে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর “সালাম সাহেবের” পরিকল্পিত মোহাসড়কটি গাড়ি চলাচল উপযোগি হয়েছে আজ দু বছর। এখন আমাদের রাস্তারটির দৃশ্যপট অন্য রকম, ব্যস্ত মোখর। পথের ঐতিহ্যবাহক ঝুলিকাঁধে পদব্রজী তৃষার্ত, ক্লান্ত, পথিকের আনাগোনা এখন আর দেখা যায় না। রাতদিন ভেঁপু বাজিয়ে নবযৌবনের চাঞ্চল্যতায় রাস্তার বুক চিড়ে গাড়ি সাইসাই দৌড়ে চলে। রাস্তা বাস্তবায়নের মূল হুতারা কেউ ই আজ বেঁচে নেই। যাদের অবদানে আমরা উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ পেলাম, তাঁরা আজ আমাদের স্মৃতি স্মরণ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বর্ণাড্য জীবনালেখ্য থেকে আমরা কোন শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি। সালাম সাহেবের মতো উদারমনা সাদামনের মানুষের মর্যাদাকেও আমরা বুঝতে পারলাম না, আফসোস ! আমরিয়া – ২৯/০৯/২০১৯

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn