পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরে বিনোদনের জন্য সিনেমা হল নেই। আগে কক্সবাজার পৌরসভায় দুটি সিনেমা হল ছিল। পর্যটনের জন্য প্রসিদ্ধ রাঙামাটি শহরেও কোনো সিনেমা হল নেই। আগে এই শহরে তিনটি সিনেমা হল ছিল। একই অবস্থা নরসিংদী জেলা শহরেও। এখানেও তিনটি সিনেমা হলের মধ্যে বর্তমানে একটিও চালু নেই। আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তিনটি সিনেমা হল থাকলেও এখন সব কটিই বন্ধ। কোনো সিনেমা হল নেই ঝালকাঠি, নড়াইল, পঞ্চগড় ও মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরেও।

সারা দেশে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা প্রদর্শনের হল বা প্রেক্ষাগৃহগুলো। হলের মালিকেরা ভবনগুলো ভেঙে ফেলে বহুতল বিপণিবিতান গড়ে তুলছেন। তাঁরা বলছেন, মানসম্মত চলচ্চিত্রের অভাবে দর্শকেরা হলবিমুখ হয়ে পড়ছে। এ কারণে সিনেমা হলের ব্যবসা মন্দা।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। এরপর থেকে সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন চার শর ঘরে নেমে এসেছে। গত দুই দশকে দেশের কোথাও নতুন কোনো পূর্ণাঙ্গ সিনেমা হল চালু হয়নি। এই করুণ চিত্রকে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী শোয়েব রশিদ চলচ্চিত্র নির্মাণের গতি কমে যাওয়াকে এর জন্য দায়ী করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চলচ্চিত্রশিল্পে প্রতিযোগিতা নেই। এবারের ঈদে মাত্র তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। হলের মালিকেরা চাইলেও এ তিনটি ছবির বাইরে অন্য ছবি চালাতে পারছেন না।

অনেক হল এখন স্মৃতি

প্রতিবছর ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে। রাজধানীতে এরই মধ্যে যেসব প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো হলো পুরান ঢাকার গুলিস্তান, নাজ, মুন, মুকুল, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা, সদরঘাটের রূপমহল, আরমানিটোলার শাবিস্তান, বাসাবোর অতিথি, আগমন, সাগরিকা, গ্যারিসন, ইসলামপুরের লায়ন ও মৌলভীবাজারের (পুরান ঢাকা) তাজমহল, পোস্তগোলার মেঘনা, যমুনা, ডায়না, শ্রীনগরের ঝুমুর, নারায়ণগঞ্জের মিনতি ইত্যাদি। ১৯৬৪ সালে পোস্তগোলায় নির্মিত হয়েছিল তখনকার সর্ববৃহৎ সিনেমা হল ‘ডায়না’, যার আসনসংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০০। এটি বন্ধ হয়েছে ২০০৭ সালের দিকে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে কারওয়ান বাজার এলাকায় পূর্ণিমা সিনেমা হলটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাজধানীর পরেই চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোরকে চলচ্চিত্র দর্শকের স্বর্গ বলে গণ্য করা হতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল এলাকায় ৪৭টি হল ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১২টি হল টিকে আছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিনের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি প্রেক্ষাগৃহ। হারিয়ে গেছে অলংকার, লায়ন্স, সানাই, রঙ্গম, সাগরিকা, বনানী, খুরশিদ মহল, নূপুর, জলসা, গুলজার, উপহার, রিদম, উজালা, আকাশ, মেলোডি ও সিনেমা কর্ণফুলী।

একসময় যশোরের পরিচিতি ছিল সিনেমা হলের শহর হিসেবে। ছিল ২১টি সিনেমা হল। এখন যশোরে মাত্র ৬টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে এখন মাত্র একটি সিনেমা হলে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। পাঁচ বছর আগে চালু থাকা উৎসব, স্মৃতি, বনানী, বর্ণালী ও কল্পনা বন্ধ হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার ৩১ হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৭টি।

খুলনা মহানগরীতে সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে মাত্র ৪টি। ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পেয়েছিল খুলনার উল্লাসিনী হলে। ঐতিহ্যবাহী এই হল বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ১০ বছর আগে। এটি এখন গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সোসাইটি সিনেমা হলে মাঝেমধ্যে নাটক মঞ্চস্থ হয়। বন্ধের তালিকায় রয়েছে পিকচার প্যালেস, চিত্রালী, লিবার্টি, ঝিনুক ও বৈকালী। কোনো রকমে চলছে শঙ্খ সিনেমা হল। চালু রয়েছে সঙ্গীতা, মীনাক্ষী ও জনতা সিনেমা হল। ডুমুরিয়া উপজেলার একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে আরও দুটি সিনেমা হল। এগুলো হলো নেত্রকোনা জেলা শহরের একমাত্র সিনেমা হল হীরামন ও নাটোরের সায়াবান।

সিলেটের সাতটির মধ্যে একটি এবং রংপুরের পাঁচটি হলের মধ্যে একটি টিকে আছে। এ ছাড়া দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুরে বর্তমানে মাত্র একটি করে হল নিয়মিত কার্যক্রম চালু রেখেছে।

চলচ্চিত্র নেই, তাই দর্শক নেই

নির্মাতা, বিনিয়োগকারী, প্রদর্শক ও পরিবেশকেরা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান না থাকা, চলচ্চিত্র বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক ও ভালো চলচ্চিত্রের অভাব—এসব কারণে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে গেছে। একই সঙ্গে ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভির বিস্তার আর ভিডিও পাইরেসির কারণে সিনেমা হলের কদর কমছে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেও সিনেমা হল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। একটা সময় চলচ্চিত্রশিল্প ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল। তবে আমরা এ ব্যাপারে মোটেও উদাসীন নই। আমরা এ ব্যাপারে মাথা ঘামানো শুরু করেছি। সিনেমা হলগুলো সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আশা করছি ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে।’

প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা বলছেন, শুধু দেশীয় চলচ্চিত্র দিয়ে এই মুহূর্তে সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কারণ ঘরে বসে স্যাটেলাইট চ্যানেলে ভারতীয় ছবিগুলো দেখছে দর্শক, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে তা প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক কমে গেছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী শোয়েব রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে বছরে ৯০ থেকে ১০০টি নতুন ছবি মুক্তি পেত। এটা গত কয়েক বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে। যে ছবিগুলো মুক্তি পাচ্ছে, সেগুলোর গল্প সমাজসংশ্লিষ্ট নয়। এসব কারণে দর্শকও হলবিমুখ হচ্ছে দিনে দিনে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহসভাপতি মনতাজুর রহমান আকবর পাল্টা হলমালিকদের দায়ী করে বলেন, ‘চলচ্চিত্রশিল্পের এই দুর্দশায় হলমালিকেরাও দায়ী। সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ ভালো নয়। পর্দা ভালো নয়। আসনব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। এ ছাড়া একটা ছবি চালাতে হলমালিকদের কোনো খরচ নেই, অথচ আমরা পুরো টাকা লগ্নি করে একটি ছবি আয়ের মাত্র ২৪ শতাংশ পাই। তা-ও বছরের পর বছর বাকি রাখেন হলমালিকেরা।’ অনেকগুলো সফল বাণিজ্যিক ছবির এই পরিচালক নিজে একজন প্রযোজকও। তিনি বলেন, এখন শিল্পীর সংকটে আছেন তাঁরা। যাঁরা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন, তাঁদের অনেকের অভিনয় দক্ষতা নেই।

মতিঝিলের মধুমিতা মুভিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী এবং মানসম্মত ছবি না পাওয়া গেলে সিনেমা হলের যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, কোনোভাবেই সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বছরে দুই ঈদ ছাড়া এখন অন্য কোনো সময় দর্শক সিনেমা হলে আসেন না বললেই চলে।’

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর মনে করেন, চলচ্চিত্রের এই সংকটের মুহূর্তে একটাই সমাধান, পুরো শিল্পটাকে নতুন করে সাজাতে হবে। সিনেমা হল পরিচালনায় সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। বিপণিবিতানগুলোয় তো বটেই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেপ্লেক্স বানানো প্রয়োজন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn