সৈয়দ মহিবুল ইসলাম– আমার পরম সৌভাগ্য বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আব্দুল হাই এর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে।  তাকে যখন দেখি তখন তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ (৫০)। কামারখালী ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় ‘মুর্শেদী প্রেস’ এ বসতেন। তখন তাঁর এক উদভ্রান্ত অবস্থা। নিজের নাম রেখেছেন ‘হাছন পছন্দ’। হাছন রাজার মরমী গানের ভূবনে নিজেকে হারিয়ে এক অতীন্দ্রীয় জগতের অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। আমি পরিচিত হওয়ার পর আমাকে আধ্যাত্মিক সাধক কবি সৈয়দ শাহনূর সম্পর্কে লিখতে তাগিদ দিলেন। তখন আমি, ইমানুজ্জামান মহি এবং শামীম লুতফার এক সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের জন্য কাজ করছিলাম। সুযোগ পেয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে কিছু লিখার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সুনামঞ্জের রাজনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে নিজেকে কিংবদন্তী তুল্য করে রেখেছেন।

১৯২৯ সালে সুনামগঞ্জ পৌরসভাস্থ আরপিন নগর তালুকদার বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই প্রখর মেধার পরিচয় দেন। ১৯৪০ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে আরপিন নগরস্থ কেবি মিয়া মক্তব থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে সমগ্র আসামে ১ম স্থান লাভ করে সুনামগঞ্জের গৌরব বৃদ্ধি করেন। ১৯৪৮ সালে জুবিলী হাইস্কুল থেকে ১ম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯৫১ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা (আইএ) পাশ করে এমসি কলেজে ভর্তি হন। ভাষা সংগ্রামে সংশ্লিষ্টতার কারণে তিনি ১৯৫২ এম সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। অবশেষে মদন মোহন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪ সালে বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি কালে গ্রেফতার হন। কারাগার থেকে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ডিস্টিংশন লাভ করে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করেন। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ভাষা সংগ্রামী হয়ে এই ছাত্র যুব নেতা নিজ সংগ্রামী জীবনের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। (টীকা)

১৯৫৬ সালে মহকুমা আওয়ামীলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে তার জীবনে নানা ঘটনা ঘটে। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর বিয়ের বরযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন- মাহমুদ আলী  (মন্ত্রী), আব্দুস সামাদ আজাদ (যুক্তফ্রন্টের এমপি), কমরেড বরুণ রায়, দেওয়ান আনোয়ার রাজা চৌধুরী, হোসেন বখ্ত প্রমুখ বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্ব। এ থেকে সমাজে তার গ্রহণ যোগ্যতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান দেশে সামরিক আইন জারী করেন। এ সময় তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। প্রথমে জয়কলস উজানীগাঁও রসিদিয়া হাইস্কুল এবং পরে শহরের এইচএমপি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এইচ.এম.পি হাইস্কুলের উন্নয়নের ভিত্তি তাঁর হাত ধরেই সূচিত হয়েছিল।

“আব্দুল হাই সুনামগঞ্জ আরপিন নগরের তালুকদার বাড়ির ছেলে। নবীন পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনে এই প্রতিভাবান ছাত্রনেতার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলনে সিলেট ও সুনামগঞ্জে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা। মুহাম্মদ আব্দুল হাইকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী কালে সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখা গঠন করেছিলেন।” (সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি- কল্লোল তালুকদার পৃষ্ঠা-১২৭)

সাংবাদিকতায় জনাব আব্দুল হাই অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। “উদারচেতা আব্দুল হাই ঢাকার কোনো পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তবে তাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় আমাদের সাংবাদিকতা। আমরা হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক সুনামগঞ্জকে মাতিয়ে রাখতাম।” (সুনামগঞ্জের একশ’ বছরের সাংবাদিকতা- হাসান শাহরিয়ার) ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দেশের দাবী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন  আব্দল হাই এবং প্রকাশক ছিলেন রাজনীতিবিদ হোসেন বখ্ত। পত্রিকাটি স্বল্প সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৬২- ৬৪ সালে সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আব্দুল হাই এবং সম্পাদক ছিলেন হাসান শাহরিয়ার। (পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার উজ্জল নক্ষত্র)। ১৯৬৪-৬৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদেও ছিলেন সভাপতি এবং সম্পাদক ছিলেন গোলাম রব্বানী। সিলেট থেকে প্রকাশিত  ‘নওবেলাল’ পত্রিকায় ও লেখালেখি করতেন।  ১৯৬২ সালে প্রথমে সাপ্তাহিক ও পরে পাক্ষিক ‘সুরমা’, ১৯৭২ সালে অর্ধ সাপ্তাহিক ‘দেশের কথা’ এবং ১৯৭৩ সালে সাপ্তাহিক ‘সূর্যের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রকাশিত ‘জনমত’ পত্রিকার সাথে ও সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে গিয়ে সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সংগ্রাম কমিটির অন্যতম যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নে থাকাকালীন সময়েই নাট্য অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর চমৎকার বাচনভঙ্গি ও সাবলীল অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করত। সিরাজ উদদৌলা নাটকের সিরাজ চরিত্রে অভিনয়ের কথা আজও নাট্যমোদীমহল স্মরণ করেন। আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন জানাচ্ছেন- কলেজের নাটক ‘নন্দলালের ফাঁসি’ নাটকে নন্দলালের ভূমিকায় অভিনয় দেখে ডঃ গোলাম কাদির তাঁর বইয়ে আব্দুল হাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে স্মৃতিচারণ করেছেন। এছাড়া নাট্য নির্দেশনা ও পরিচালনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তার প্রচেষ্টা ও অবদান অনস্বীকার্য। যার স্বীকৃতি স্বরূপ সুনামগঞ্জে নির্মিত আধুনিক শিল্পকলা একাডেমী ভবনে মিলনায়তনের নাম করণ করা হয়েছে -‘আব্দুূল হাই মিলনায়তন’।

ব্যক্তি আব্দুল হাই সম্পর্কে মু. আব্দুর রহীম লিখেছেন- ‘সদালাপী. সুরসিক, বিদগ্ধ, বন্ধু বৎসল, অমায়িক ও অতিথিপরায়ণ আব্দুল হাই অতি সহজেই সকলকে কাছে টানতে পারতেন। ফলশ্রæতিতে সুনামগঞ্জের ছাত্র শিক্ষক সুধীজনসহ সকলেরই তিনি প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন।’ তিনি তাকে উঁচু মানের জাত মরমী কবি হিসেবে অভিহিত করেছেন। হাছন রাজার গান নিয়ে আব্দুল হাই অনেক গবেষণা করেছেন। বলা যায় জীবনের এক বৃহৎ সময় পার করেছেন হাছন ভাবনায়। ‘উদাস হাসন রাজা কথা’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যা মুদ্রিত হয়েছিল কিনা জানা যায় নাই। এ ছাড়াও আরো রচনা করেছেন -‘হাসন রাজার গান কি ছিল কি হয়েছে কি হওয়া উচিত’, ‘গণী সংগীত’, ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ ইত্যাদি। তবে তাঁর রচিত গীতিগ্রন্থ হচ্ছে ‘উতলা বাতাসে’। মু. আব্দুর রহীম এই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেছেন। এতে ৪২ টি মরমী গান আছে বলে জানা যায়। বইখানির প্রথমে স্থান পেয়েছে লেখকের কথা, তারপর একটি হামদ ও নাত যাতে লেখকের আল্লাহ ও রাসুল প্রেম দৃশ্যমান।

‘উতলা বাতাসে’ গ্রন্থের একটি গানের কয়েকটি চরণ দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই ঃ

ছল করে শুধু কাঁদায়, ধরা দেয় না

এমন সাজানো বাসরে তুমি নাই

বধু ও শুনো গো কোথা যে তুমি আছো

তোমারে খুঁজিয়া না পাই।

বুকের আশার সমাধি উপরে কি

কুসুম সাজাতে আসিবে তুমি শেষে

তোমার মনে কি এ আশা

নয়নপথে যে আসিয়া ফিরে যাও

নয়ন ধরিতে পারে না তোমা তাই

পলকে পলকে হারাই।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক। অধ্যক্ষ (অবসর প্রাপ্ত) মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, মৌলভীবাজার। সাবেক উপাধ্যক্ষ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ, সুনামগঞ্জ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn