মরিয়ম চম্পা –ব্যাংকার গহর জাহান। নিজের ঘর ছিল না, ছিল না স্বামী কিংবা সন্তান। ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল আগে। সোমবার কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ চেয়ারে ঢলে পড়েন।  সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। উত্তরায় প্রাইম ব্যাংকের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এই মৃত্যু ব্যথিত করেছে বহু মানুষকে। তার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক জানিয়েছেন অনেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন ওপেন হার্ট সার্জারি হয় গহর জাহানের। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেণ। ২০০০ সালে প্রাইম ব্যাংকে চাকরি হয় তার। ছিলেন রূপে গুণে অনন্যা। কিন্তু ওপেন হার্ট সার্জারির কথা জেনে বহুবার পাত্রপক্ষ পিছিয়ে যায়। এক সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নেন এই লড়াকু নারী। কখনো বিয়ে করবেন না। নিজের সংসার সন্তান হয় নি তাতে কি! সন্তানের মতো করে ছোট ভাইবোনদের মাতৃস্নেহে পরম মমতায় বড় করেছেন। আগলে রেখেছেন ভাইয়ের সন্তানদের। যুক্ত হয়েছেন সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডে। তার সহায়তায় একাধিক এতিম ছাত্র কোরআনে হাফেজ হয়েছেন। বোনের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ছোট ভাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মারুফ নাওয়াজ।

 তিনি  বলেন, বড় দুঃখী মেয়ে ছিলেন তিনি। পুরো জীবনটাই মানুষের সেবায় উৎসর্গ করে গেছেন। যার যায় সে বোঝে, হারানোর কি যন্ত্রণা। তিনি শুধুমাত্র আমাদের বোন ছিল না।  ছিল আমার ছোট দুই সন্তান ও ভাইদের মায়ের মতো। ৫ ভাই তিন বোনের মধ্যে বোনদের সবার ছোট ছিল গহর। তার কাছে কেউ আর্থিক সাহায্য চাইতে এসে খালি হাতে ফেরত যায় নি। প্রয়োজনে ধার দেনা করে মানুষকে সাহায্য করেছেন। তার নিজস্ব সঞ্চিত কোনো অর্থ ছিল না। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে ইন্ডিয়ায় যে চিকিৎসকের কাছে ওপেন হার্ট সার্জারি করেছে সে গহরকে অনেক অনুরোধ করে যেন একবার অন্তত চেকআপ করায়। ডাক্তার তাকে মা বলে সম্বোধন করতেন। ছোট ভাই দুবাই থেকে টাকা পাঠিয়ে চেকআপ করতে যেতে অনেক অনুরোধ করেছে। আমি ইতোমধ্যে তার পাসপোর্ট জমা দিয়েছি ভিসার জন্য। এরপর তো সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা মৃত মাওলানা নাওয়াজ ছিলেন পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম বার্ধক্যের ভারে অনেকটা নূয়ে পড়েছেন।
বোন গহর জাহানের বিয়ে না করার বিষয়ে তিনি বলেন, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখন পর্যন্ত ততোটা উন্নত হয় নি। তার বিয়ের অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব আসলে সার্জারির বিষয়টি আমরা কোনো ভাবে লুকাই নি। আমরা খুব সহজে পাত্রপক্ষকে এটা জানালে পরবর্তীতে তারা আর বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করে নি। ও ছিল আমার ইমিডিয়েট এক বছরের বড়। ওকে আমরা প্রায়ই বলতাম তুমি বিয়ে করো। তখন সে বলতো ‘না ভাই। বুকের ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য হয় তো অনেকে আমাকে পছন্দ করে না’। আমার বোন দেখতে অনেক গুড লুকিং এবং সুশ্রী ছিল। অনেকটা অভিমান নিয়ে বলতো বাকীটা জীবন আমি তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই। সে নিজেকে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। রোটারি ক্লাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাবের সদস্য ছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় দান খয়রাত করতেন। নিজ খরচে একাধিক এতিম ছেলেকে হাফেজ তৈরি করেছেন। দুঃস্থদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অফিসের সহকর্মীদের কাছেও সে ছিল প্রিয় মুখ। তার জানাজায় সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। 
দিনে রাতে যে কারো কোনো বিপদে ছুটে যেতেন। বলতেন, মাদার তেরেসা যেভাবে নিজের জীবন মানব সেবায় ব্যয় করেছে আমিও সেভাবে মানবতার সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করতে চাই। বোন হিসেবে সে ছিল অসাধারণ। অনেকটা মায়ের মত। আমার ছোট দুই ভাইকে পড়ালেখা থেকে শুরু করে বিদেশে পাঠানো সবকিছুই আমার এই বোন করেছে। মা আমাদের জন্ম দিলেও ছোট ভাই বোনদের প্রতি সে এত যন্ত্রশীল এবং কেয়ারিং ছিল যেটা বলে বোঝানো যাবে না। সে উত্তরাতে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। আমার ছোট দুই ছেলেকে আব্বাজান বলে ডাকতেন। এমনকি আমার বিয়ের কনে দেখা থেকে শুরু করে সবকিছুই করেছেন তিনি। আমার বাচ্চাদের ছবি তার কর্মস্থলে ঝুলিয়ে রাখতেন। ব্যাংকের কাস্টমাররা জানতে চাইলে বলতেন এরা আমার বাচ্চা। গহরের বয়স হয়েছিল ৪৪ বছর। বোনের ফিরতে একটু দেরি হলে ফোন দিয়ে বলতাম তোমার এতো দেরি হচ্ছে কেনো। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।
ঘটনার দিন সকালে আমার স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে নাস্তা করেণ। এসময় সে বলেন, ‘আমার বাচ্চারা কই। আজ আমার মিটিং আছে একটু আগে যেতে হবে। তোমরা ভালো থেকো’। এটাই ছিল আমাদের সঙ্গে তার শেষ কথা। প্রত্যেক মেয়ের স্বপ্ন থাকে নিজের একটি ছোট্ট সুন্দর সংসার হবে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ছেলেটা আজও জন্মালো না। যে আমার বোনের শারীকির এই তুচ্ছ দুর্ঘটনাকে আপন করে নিবে। এটা শুধু আমার নয় আমার পুরো পরিবারের দুঃখ। আমাদের বলেছেন, ‘আমি যে সকল সমাজসেবামূলক কাজ করতাম এগুলো তোমরা নিয়মিত করবে’।       

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn