প্রতীকী ছবি-

গণতন্ত্র নিয়ে দু’টি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে যে, এর শুরু প্রাচীন এথেন্সে ও সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর এটি মূলত পশ্চিমেই আবদ্ধ রয়েছে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড স্টাসেভাজের মতে, উভয় ধারণাই ভুল। তিনি মনে করেন, ওই ধারণাগুলো ছাড়া, বর্তমান সময়ের গণতন্ত্র নিয়ে আশা ও ভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভারসাম্যতা আরো ভালোভাবে বিবেচনা করা যাবে। স্টাসেভাজ প্রমাণ করেন যে, গণতন্ত্র প্রাচীন এথেন্সেরও আগের সভ্যতাগুলোতেও বিদ্যমান ছিল। সে সময় সরকাররা গণতন্ত্রকে দেখতো পরামর্শ বা সম্মতি হিসেবে। প্রাচীন গ্রিসের পাশাপাশি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, বৌদ্ধ ভারত, আমেরিকান গ্রেট লেকসের আদিবাসী ভূখণ্ডগুলো, দখল-পূর্ববর্তী মেসোআমেরিকা ও উপনিবেশ-পূর্ববর্তী আফ্রিকাতেও গণতন্ত্র দেখা গেছে। এই ধারণা মাথায় নিয়ে স্টাসেভাজ লিখেন, পরিস্থিতি যথাযথ হলে মানুষ সহজাতভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আওতায় চলে আসে। ধাঁধাটা হচ্ছে, স্বৈরাচারী শাসনও সহজাতভাবেই আসে। গণতন্ত্রের মতো এটাও বহু জায়গায় দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন চীন ও ইসলামিক বিশ্বে কয়েক শতক ধরে, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রসহ স্বৈরাচারই ছিল প্রচলিত রীতি। গণতন্ত্রের শুরু কেন হয়েছিল ও কোথায় হয়েছিল তা খুঁজে দেখতে প্রত্নতত্ত্ব, ভূ-বিজ্ঞান, জনতত্ত্ব ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা থেকে প্রমাণ টেনে এনেছেন স্টাসেভাজ।

তার বর্ণনায়, মূল বিষয়টি ছিল তথ্য।
একেবারে শুরুর দিকে, যেসব জায়গায় শাসকরা জনগণ কী উৎপাদন করছে সে বিষয়ে কম জানতো ও তা জানার উপায়ও কম ছিল, সেসব জায়গায় সাড়ম্বরে গণতন্ত্রের উত্থান ঘটেছে। তারা হয়তো শুল্ক আরোপযোগ্য উৎপাদন (খরচ হওয়া রাজস্ব) কম ধরতো বা (অমান্যতা উস্কে দিয়ে) বেশি  ধরতো। এর চেয়ে জনগণ কী পরিমাণে উৎপাদন করছে তা জিজ্ঞেস করাই ভালো ছিল। আর এর বদলে, শাসকরা জনগণের চাহিদাও জানতে পারতো। সাধারণত যেসব জায়গায় জনসংখ্যা কম ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র দুর্বল ছিল বা ছিলই না, সেসব জায়গায় এ প্যাটার্ন দেখা গেছে। বড় জনসংখ্যার ক্ষেত্রে পরামর্শ নেয়ার পদ্ধতি প্রয়োগযোগ্য ছিল না। এর বদলে শাসকরা উৎপাদনের খোঁজ নিতে কর্মকর্তাদের পাঠাতেন। কিছু সময় পরেই তারা সেনাবাহিনীতে ভর্তিযোগ্য তরুণদের খোঁজ নেয়া শুরু করলেন। ধীরে ধীরে সৃষ্টি হলো আমলাতন্ত্র। তাদের সহায়তায় স্থানীয় রীতিনীতির ওপর আরোপিত হয় স্বৈরশাসন। আধুনিক যুগ পূর্ববর্তী সময়ে, যেসব জায়গায় বিস্তৃত পরিসরে মাটির মান ভালো ছিল, উৎপাদন বেশি হতো ও জানাশোনা, বিশেষ করে লেখা ও মাপার দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল, সেসব জায়গায় স্বৈরশাসনের আমলাতন্ত্র ফুলেফেঁপে উঠে। এরকম শাসনের আওতায় বিপুল পরিমাণে কর আরোপ করা যেত। সং চীনে (১০-১৩ শতক) ও আব্বাসি খিলাফতের (৮-১৩ শতক) সময় বছরে উৎপাদিত মোট পণ্যের ওপর যথাক্রমে ১০ ও ৭ শতাংশ কর আরোপ করা হতো। অন্যদিকে, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় শাসকরা কোনোরকমের ১ শতাংশ কর আরোপ করতে পারতেন।

একবার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রগুলো ভেঙে ফেলা কঠিন ছিল। তারা আধুনিকতা ও নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারতো। প্রাথমিক দিকের গণতন্ত্রগুলো ছিল এর বিপরীত। উল্লেখযোগ্যভাবে, আধুনিক রাষ্ট্রগুলো ও অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের মুখে দুর্বল ছিল গণতন্ত্র। বহু জায়গায় এমনটা মেনে গণতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে। যদিও এমনটা সকল জায়গায় আবশ্যিক ছিল না। কিছু জায়গায় গণতন্ত্র বেঁচেও থাকে। অন্যকথায়, আধুনিকতা ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হয়তো স্বৈরশাসনের পক্ষে কাজ করেছে বা গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো প্যাটার্ন ছিল কি? স্টাসেভাজ মনে করেন, ছিল। তিনি এটাকে বলেন ‘সিকুয়েন্সিং’। তার ভাষ্য, শুরুর দিককার সরকারি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি অনুমতি নিয়ে আগে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে পরবর্তীকালে স্বৈরতন্ত্র বা স্বেচ্ছাতন্ত্র এড়িয়ে আমলাতন্ত্র নির্মাণ সম্ভব। এক্ষেত্রে, কোন্টা আগে করা হচ্ছে তার ওপর পুরো বিষয়টি নির্ভর করে।
প্রথমে পদক্ষেপ নেয়ার সুবিধা

অদ্ভূতভাবে, এই যুক্তির জন্য পশ্চিমের দিকে ভিড়তে হয়। পুরো বিশ্বের মধ্যে একমাত্র সেখানেই প্রাথমিক ছোট পরিসরের গণতন্ত্র পরবর্তীতে প্রায় সরাসরি, সবচেয়ে আধুনিক ও প্রতিনিধিত্বকারী গণতন্ত্রে রূপ নিয়েছে। তাহলে গণতন্ত্র কি বিশেষভাবে পশ্চিমাই হয়ে গেল না? আধুনিক গণতন্ত্রের তিনটি ঢেউ দেখা গেছে ১৯ শতকে, ১৯৪৫ পরবর্তী সময়ে ও ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল পশ্চিমা গণতন্ত্র। বহু ধস দেখা সত্ত্বেও সবচেয়ে ভালোভাবে টিকে আছে তারা। কিন্তু স্টাসেভাজ তাও বলেন, তাতে অপরিহার্য কিছু ছিল না- যেমন ধরুন, উদারমনা দৃষ্টিভঙ্গি বা সম্পদের জন্য সম্মান, বা শিল্পের জন্য উপহার- যা পশ্চিমা বিশ্ব ও আধুনিক গণতন্ত্রকে অতীতের ভাগ্যের চেয়েও দূরে গিয়ে একসঙ্গে করেছে। আধুনিক যুগ পূর্ববর্তী ইউরোপে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কোনো কার্যকরী আমলাতন্ত্র ছাড়াই গণতান্ত্রিক প্রথা ও দুর্বল শাসক বিদ্যমান ছিল। স্টাসেভাজ লিখেন, যেখানে এমনটা ঘটে ও যেখানে স্বৈরশাসনের মুখে গণতন্ত্র ধ্বংস না হয়ে যায়, সেখানে সম্মতিপ্রাপ্ত সরকার বেশ গভীর ছাপ ফেলে যায়। গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র- উভয়ের শেকড়ই শক্ত। উভয় ব্যবস্থাই টিকে থাকবে, এমনটা প্রত্যাশা করার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। এত বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের জন্য এ উপসংহার অত্যন্ত স্বল্প উৎপাদন মনে হতে পারে। কিন্তু অস্বচ্ছন্দতা মেনে নেয়াও ‘গণতন্ত্রের হ্রাস ও উত্থানের’ গুণগুলোর একটি। এটা সাম্প্রতিক পাণ্ডিত্যের আদেশে পুরো বিশ্বজুড়ে ছেয়ে গেছে। এর জন্য শাসক ও শাসিতের মধ্যে দরাদরির মতো রাজনীতির একটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। সত্যিকারের মানুষ কী ভেবেছিল ও কী করেছিল তা বুঝতে হবে এবং মূল ধারণাগুলোর নিখুঁত বিশ্লেষণ করতে হবে। এর সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলো নেতিবাচক: এটি দেখায়, গণতন্ত্রের প্যাটার্ন কতটা জটিল এবং প্রমাণ অনুসারে, এর অতীত ও সম্ভাবনার সহজ বর্ণনা কীভাবে হোঁচট খায়। (ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn