দীর্ঘ ৬ মাস নিয়োগকর্তার বাড়িতে আটকে থাকার পর ফিরোজা বেগমকে বেতনের অর্থ ছাড়াই বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। তার স্বামী তার ওপর ক্ষিপ্ত কারণ তিনি খালি হাতে দেশে ফিরেছেন। তাকে বাড়িতে প্রবেশে পর্যন্ত বাধা দেয়া হয়। গত ১৪ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন ফিরোজা। নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তার থেকে বেঁচে ফিরতেই তার জমানো সব টাকা শেষ হয়ে যায়। ৪০ বছর বয়স্ক ফিরোজা শেষে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে তিনি তার মা ও দুই অক্ষম বোনের দায়িত্ব নিয়েছেন।

বছরের পর বছর ধরে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের পরিবারের দায়িত্ব টেনে নিচ্ছেন এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে পুরো জাতিই চরম দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে আসছে।বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বদ্ধপরিকর। তবে মহামারির কারণে এরইমধ্যে লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সরকারি গবেষণা বলছে, চাকরি হারানো শ্রমিকদের পরিবার আবারো দারিদ্র্যতায় পতিত হচ্ছে।   এক বছর আগে ফিরোজা বেগম প্রতি মাসে তার সৌদি মালিকের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা করে পেতেন। এর পুরোটাই তিনি তার স্বামী ও বাবা-মাকে পাঠাতেন। তার টাকা দিয়েই স্বামী বাড়ি বানায়, জমি কেনে। তার বাবা মায়ের চিকিৎসার খরচ নিশ্চিত হয়। তিনি বলেন, আমার এখন কোনো আয় নেই। আমার পরিবার এখন অতিকষ্টে দিন যাপন করছে। আত্মীয়দের থেকে ঋণ নিয়ে আপাতত বেঁচে আছি। তাদের কাছে আমি দেড় লাখ টাকা ঋণ করেছি। আমি জানি না, কীভাবে এই টাকা ফেরত দেবো।

বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বিদেশে কাজ করতে শ্রমিকদের উৎসাহ দেয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ ১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পায়। এই টাকায় দেশের গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে গত বছরের এপ্রিল মাসে এক দশকের মধ্যে সবথেকে কম রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ যে অভূতপূর্ব উন্নতি করছিল তার গতি থেমে যায়। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম জানিয়েছে, মহামারি চলাকালীন প্রবাসী শ্রমিকের চাকরিচ্যুত হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে জানিয়েছিল, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে মহামারির কারণে এই উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত বছরের জুন নাগাদ দারিদ্র্যের হার বাড়তে বাড়তে ২৯.৫ শতাংশে পৌঁছায়।

বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা ইনোভিশনের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের নিম্নআয়ের পরিবারগুলো কোনো ধরনের আয় ছাড়া মাত্র ৮ দিন চলতে পারে। যেখানে দেশের বেশির ভাগ পরিবার চলতে পারবে মাত্র ১১ দিন।  বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক ৩৫ হাজার বিদেশ ফেরত শ্রমিকের ডাটাবেজ তৈরি করেছে। তাদেরকে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছে ব্র্যাক। সংস্থাটির প্রবাসী প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের প্রথম থেকে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। এখন পর্যন্ত তারা কোনো সাহায্য পায়নি। যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা খালি হাতে ফিরে এসেছেন। এই মানুষগুলো জানে না তারা কীভাবে বেঁচে থাকবেন। দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপরেই এর প্রভাব পড়তে পারে। গত বছরের জুনে জাতিসংঘের মাইগ্রেশন এজেন্সি একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, বিদেশ থেকে ফেরা শ্রমিকদের বেশির ভাগই এখনো বেকার।

নোয়াখালীর পশ্চিম চরবাটা গ্রামে গত এক দশকে প্রতিটি বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ বিদেশে গিয়েছে। তবে তাদের বেশির ভাগই এখন ফিরে এসেছে। রিয়াজ মাহমুদ নামের একজন বলেন, করোনার কারণে আমার জীবন থেমে গেছে। আমি ভালো ছিলাম কিন্তু এখন দ্রুত সবকিছু খারাপ হচ্ছে। তিনি কাতারে গিয়েছিলেন ২০১০ সালে। কিন্তু এখন তার প্রায় ৬ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।

বাংলাদেশি এনজিও কোস্টের প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, তার সংস্থা বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের প্রাধান্য দিচ্ছে এবং তাদেরকে মূলধারায় যুক্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে যাতে তারা আবারো বিদেশে ফিরে গিয়ে কাজ করতে পারেন। তাদের জীবন কঠিন হয়ে যাচ্ছে কারণ তাদের সব সঞ্চয় শেষ দিকে। তাদের অনেকেই ট্রমায় ভুগছেন। যদি এমন অবস্থা চলতে থাকে তাহলে তা একটি সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।

রিয়াজ মাহমুদকে তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। তিনি তার বেশির ভাগ জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক মানুষ কাজ খুঁজছেন তাই কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখন তার আবারো সব বিক্রি করে ওমান যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, আগে আমি প্রতিমাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতাম। অনেক সংকট সামাল দিয়েছি আমি। আমি ভেবেছিলাম, বিদেশে চাকরি করে ভালোমতো নিজের জীবন চালিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু করোনাভাইরাস আমার সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে।-মানবজমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn