ঘটনা পরম্পরায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক গতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হতে থাকে, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ছাত্র-তরুণ, প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী এবং প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা এ চিন্তাধারাকে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকে বিকশিত করে চলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও বামপন্থী ধারার নেতাকর্মীরা এ ধারাকে বিকশিত করে চলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন আওয়ামী মুসলিম লীগে ছিলেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের অনেক বিষয়ে জানা যায়। তা ছাড়া আবুল মনসুর আহমদ, বদরুদ্দীন উমর এবং আরও অনেকের লেখা থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। আইউব খানের সামরিক শাসন ও পরবর্তী ঘটনাবলির কারণে রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তখন অল্পদিনের মধ্যেই পাঞ্জাবি কর্তৃত্বের প্রশ্ন সামনে আসে।
সাংস্কৃতিক ভিন্নতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রও প্রকাশিত হয়। এর আগেই ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি-প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতবিরোধ হয়। ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের সদস্য হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী। আর ভাসানী ছিলেন ক্রমাগত প্রবলভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনকারী ও পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা।
ভাসানী ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবল সমর্থক। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন নীতির সমর্থক এবং মস্কো ও পিকিংয়ের নীতিবিরোধী। কাগমারী সম্মেলনে এ বিরোধ প্রকাশ পায়। সম্মেলনের কিছু পরে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যায় এবং মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের একাংশ নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আওয়ামী লীগে থেকে যান এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অনুকূলে বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি প্রচার করে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ কয়েকজন নেতা ছয় দফা মেনে নেননি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ও ছাত্রলীগের নেতাদের দৃঢ় সমর্থনের ফলে আওয়ামী লীগ শেখ মুুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে নেয়। ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মওলানা ভাসানী এবং বামপন্থীরা তখন উপযুক্ত রাজনৈতিক ভূমিকার অভাবে পেছনে পড়ে যান।
৬ দফা আন্দোলনকালে আইউব সরকার ‘State verses Shekh Mujib and others’ নামে ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে একপর্যায়ে মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে মামলা আরম্ভ করে। এ মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব অত্যন্ত প্রবল হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জনসমর্থন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। ১৯৬৮ সালের শেষে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান’ শুরু হলে ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে আইউব সরকার মামলা উঠিয়ে নিতে এবং আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এ কারণে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার আয়োজন করে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি মুজিব ভাই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের হত্যাযজ্ঞের পর তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ইসলামাবাদে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি ও মস্কোর সহায়তা নেন এবং বিশ্ব জনমত জয় করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাজউদ্দীন সরকারই ছিল মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন সরকার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা প্রায় প্রতিদিন উল্লেখ করেছে। ৬ দফা আন্দোলনকালে সাংগঠনিক দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ যেভাবে সংগঠিত হওয়ার দরকার ছিল সেভাবে সংগঠিত হয়নি।
সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়েই তাজউদ্দীন সরকারকে কাজ করতে হয়েছে, একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি অর্জনের প্রয়োজনে তাজউদ্দীন সরকার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ড গঠন করে। জয়েন্ট কমান্ডের প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল অরোরা আর মুক্তিবাহিনী প্রধান ছিলেন কর্নেল ওসমানী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জয়েন্ট কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। সে অবস্থায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামাবাদ থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন। তারপরই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং তাজউদ্দীনকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করেন।
যে সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে তাজউদ্দীনকে কাজ করতে হয়েছে, সেই দুর্বলতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে ঐক্য দৃঢ় হয়নি। বিরোধী দল হিসেবে জাসদ গঠিত হয়েছে। মওলানা ভাসানী ও পিকিংপন্থীরা সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। মোজাফফর আহমদ ও মস্কোপন্থীরা এক বছর সরকারের বিরোধিতা করে এবং পরে সরকারকে সমর্থন দেয়। দেশে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা প্রবল হয়ে ওঠে। নানারকম অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপও দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিপন্ন করার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চালাতে থাকে।

সে অবস্থাতেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য এবং জনজীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। বন্যার কারণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতার জন্য ১৯৭৪ সালে দেশে একটি বড় দুর্ভিক্ষ হয়। বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য এবং জনজীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর প্রতি দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বান জানিয়ে গঠন করেন একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’। কিন্তু তার আগে তিনি তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত করেছিলেন। বাকশালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হন। মূল ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করেন।

আমাদের জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলন এবং তার সহকর্মী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বড় ও গৌরবজনক অধ্যায়। এ ঘটনাবলির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু চিস্মরণীয়। রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে তৎকালীন ইতিহাসকে গভীরভাবে জানা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা বাঙালি হিসেবে আমাদের সবারই কর্তব্য।

শ্রুতিলিখন : এমরান হোসেন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn