জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ছাতক:: ছাতকে ব্যবসা-বাণিজ্যের একসময়ের ঐতিহ্য ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ কোম্পানী এখনো তাল গাছের মতো ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাচিন ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকপাল ওই কোম্পানীর কার্যালয়টি আজো ইতিহাস হিসেবে এখানে স্বাক্ষ্য বহন করছে। শহরের প্রানকেন্দ্র বাগবাড়ি এলাকায় পৌরসভা অফিস সংলগ্ন সুরমা নদীর তীরঘেষা মনোরম পরিবেশে ঐতিহাসিক ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান। ছাতক তথা বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাসের সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িত প্রাচীনতম ব্যবসায়িক ওই কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়টি বর্তমানে অনাদর-অবহেলা ও অযতেœ পড়ে আছে। দেশের চুন ও পাথরসহ বিভিন্ন ব্যবসা মূলত এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল বলে এখানে জনশ্র“তি রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, দু’শতাধিক বছর পূর্বে এ অঞ্চলে সর্ব প্রথম চুন ও চুনাপাথর ব্যবসার সুচনা করেন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ কোম্পানীর স্বত্ত্বাধিকারী ইংল্যান্ডের নাগরিক ব্যবসায়ী কিম বারকী। তার নামানুসারেই সিলেট অঞ্চলের পাথর, চুনাপাথর, কমলা পরিবহনের জন্য এক বিশেষ ধরনের নৌকার নামকরণ করা হয়েছিল বারকী নৌকা। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে ও ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য তিনি তৎকালীন সময়ে সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দৃষ্টিনন্দন সু-বিশাল ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ কোম্পানীর কার্যালয়। অবহেলায় পড়ে থাকলেও কারুকাজ মন্ডিত টিন সেডের বাহারী ও বিলাসবহুল কার্যালয়টি পথচারীদের নজর কাড়ে এখনো। পৌরানিক নির্মাণ শিল্পের সুচারু শৈল্পীক নিদর্শন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ নামের কার্যালয়টি এতোটুকুও মলিন হয়ে যায়নি। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা কেন্দ্র ও শিল্পাঞ্চল হিসেবে খ্যাত ছাতকের নাম এশিয়া মহাদেশের ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে অনেক আগেই। চুন, চুনাপাথর, পাথর ও বালু ব্যবসা এবং ব্রিটিশ ভারতে ওই অঞ্চলের চেলা পাহাড় এলাকায় উৎপাদিত কমলা, সাতকড়া, তেজপাতার ব্যবসার উপর নির্ভর করে ব্যবসায়িরা যুগ-যুগ ধরে জিবীকা নির্বাহ করে আসছে। চুন ও পাথর ব্যবসার সাথে ছাতকের কমলা লেবুরও ব্যাপক সুনাম ছিল উপ-মহাদেশের সর্বত্রই। তখন চুন, চুনাপাথর ও ভোলাগঞ্জের পাথরের সাথে মেঘালয়ের কমলালেবুও ছিল এখানের প্রধান ব্যবসায়ি পণ্য। বৃহত্তর সিলেট মেঘালয় রাজ্যের অধিনে থাকায় তৎকালীন সময়ে মেঘালয়ের চেলা এলাকা ভৌগোলিক ও প্রশাসনিকভাবে ছাতকের অন্তর্ভূক্ত ছিল। চেলা এলাকায় উৎপাদিত প্রচুর কমলালেবু শহরের কাষ্টম ঘাট হয়ে ‘ছাতকের কমলা’ নামে উপ-মহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো ব্যবসায়িদের মাধ্যমে।

এভাবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় ছাতকের কমলালেবু। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর কমলালেবুর সব বাগান ভারতের অংশে পড়ে যাওয়ায় বিশ্বখ্যাত সুস্বাদু কমলার ব্যবসা এ অঞ্চলের ব্যবসায়িদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ব্যবসায়িক সুত্র ধরে প্রায় আড়াইশ বছর আগে এ অঞ্চলে আগমন ঘটে কিম বারকী নামের এক ইংলিশ ব্যবসায়ির। সর্ব প্রথম তিনিই চুন ব্যবসা শুরু করেন বলে এলাকায় এখনো জনশ্রুতি আছে। চুন ব্যবসার পাশাপাশি এখানের উৎপাদিত কমলালেবুও ইউরোপে রপ্তানী করে তৎকালীন সময়ে কিম বারকী প্রচুর ব্যবসায়িক মুনাফা ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। সেই সাথে তিনি চুন ব্যবসাকে শৈল্পিক রূপ দিতে তৎকালীন সময়ে বিশেষ ভুমিকা রেখেছিলেন বলে জানা যায়। দেশ বিভাজনের পর কিম বারকী দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় ঢাকার মাহমুদুর রহমান নামের এক শিল্পপতির কাছে ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ নামের প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তী সময় থেকে এ কোম্পানীর ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন শহরের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মৃত রবিন্দ্র কুমার আচার্য। দীর্ঘদিন তিনি সততা ও নিষ্টার সাথে ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ কোম্পানী পরিচালনা করেন। তার মৃত্যুর পর এখানের সকল ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা হলে ইংরেজ ব্যবসায়ির প্রতিষ্ঠা করা ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ নামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি শুধু স্বাক্ষী হিসেবে দাড়িঁয়ে রয়েছে সুরমার তীরে। প্রতিষ্টানের একটি বিশাল সাইনবোর্ডও রয়েছে। কোম্পানীর কার্যালয় ছাড়াও কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ভূ-সম্পদ ও একটি আবাসিক ভবন রয়েছে এখানে। স্থানীয় দু’ব্যক্তি কেয়ারটেকার ও নৈশ প্রহরী হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাচীনতম ব্যবসায়িক নিদর্শন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ণ এ অঞ্চলের ইতিহাস বহন করে আসছে। তবে রক্ষনা-বেক্ষণের অভাবে প্রাচিন ও ঐতিহাসিক ওই নিদর্শনটি যেকোন সময় হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn