সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গত ১১ অক্টোবর নির্যাতনে মারা যান নগরের আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান আহমদ (৪৪)। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ফাঁড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করে রায়হানের মায়ের কাছে ফোন দেওয়া হয়েছিলো। টাকা নিয়ে গেলেও রায়হানকে আর জীবিত ফিরে পাননি পরিবারের সদস্যরা।  তবে রায়হানের মা সালমা বেগম মনে করেন, কেবল টাকার জন্য নয়, রায়হানকে হত্যার পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ। একটি গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে সালমা বেগম বলেন, ‘শুধু টাকার জন্য নয়, রায়হানকে হত্যার পেছনে বড় কোনো কারণ আছে নিশ্চয়। নইলে এভাবে কেউ মারে? কী কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে রায়হানকে, আমি তো মা, কী করে সই, আমি তো ভাবতেই পারছি না…’

রায়হানের মৃত্যুর পর ময়নাতদন্তে ১১১ টি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন চিকিৎসকরা। তার হাতের নকও উপড়ানো ছিলো। রায়হানকে নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বহিস্কৃত ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া।   তবে সালমা বেগম মনে করেন, শুধু আকবর নয়, এই ঘটনার সাথে আরও অনেক জড়িত আছে। রায়হানকে হত্যার সাথে আকবরের সামনে ও পেছনে অনেকই জড়িত। আকবরসহ কয়কেজন অভিযুক্ত শনাক্ত হওয়ার পরও গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সালমা বেগম। তিনি বলেন, এই ক্ষোভ কেবল আমার নয়, এই ক্ষোভ সবার। আজ যদি পুলিশ না হয়ে কোনো সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ থাকত, তাহলে কি গাফিলতি করতে পারত পুলিশ? গণদাবির মুখে আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতেই তো পুলিশকে আমরা দেখি। এখন পুলিশের কাছ থেকে পুলিশের অপরাধের বিচার পাব না? আমার ছেলে হত্যার বিচারের নিশ্চয়তা চাই।

তিনি বলেন, পিবিআই তদন্ত করছে, তারাও তো পুলিশ। ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। আমার তো মনে হয়, এই ৭২ ঘণ্টা শুধু ঘণ্টা নয়, ৭২টা সন পেরোতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন মা। তার কাছে আমার আবদার, আমার রায়হানের মধ্য দিয়ে যেন চিরতরে বন্ধ হয় বাংলাদেশে পুলিশি হেফাজতে সব নির্যাতন-হত্যা। কোনো মাকে যেন আমার মতো ছেলে হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় নামতে না হয়। হত্যার পর রায়হানের লাশ পুলিশ বেওয়ারিশ বলে চালিয়ে দেওয়ার দেওয়ার চেষ্ঠা করেছিলো বলেও অভিযোগ মায়ের। সালমা বেগম বলেন, পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের পর রায়হানের পরনের শার্ট-প্যান্ট পাল্টে দেওয়া হয়েছিলো। মর্গে লাশের পরনে যে শার্ট-প্যান্ট ছিলো এগুলো রায়হানের না। মর্গে ছেলের লাশ দেখে এই ব্যাপারটি আমিই প্রথম চিৎকার করে বলেছিলাম। আমার মনে হয়, মারতে মারতে ফাঁড়িতেই মেরে ফেলা হয়েছে রায়হানকে। পোশাক বদল করে হয়তো বেওয়ারিশ লাশ বানানোর কোনো কারসাজি থাকতে পারে। ফাঁড়িতেই যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন তো কোনো পাবলিক জড়িত না। সবাই ফাঁড়ির পুলিশ। তাঁদের কয়েকজনকে আমি মর্গে দেখে গালিও দিয়েছি। বলেছি, আমার ছেলের পরনে এই শার্ট-প্যান্ট বদল করে লাশটা বেওয়ারিশ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো আমি রেখে দিয়েছি। তদন্ত করলে এখান থেকে অনেক কিছু বের হতে পারে।

হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে রায়হানকে ছিনতাইকারী দাবি করে পুলিশ অপপ্রচার চালিয়েছে দাবি করে সালমা বেগম বলেন, পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দিতে এসব মিথ্যা বলেছে। পুলিশকে আমরা রক্ষক বলি। রক্ষকেরাই ভক্ষণ করল আমার রায়হানকে। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে আসা ফোন, মানুষের প্রতিবাদ, মিডয়ার ভূমিকার কারণে এসব অপপ্রচার টিকেনি বরং সত্য প্রকাশিত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। সালমা বেগম বলেন, আমি বা আমরা শুরু থেকে যেসব কথা বলছিলাম, তা থেকে এক চুলও সরিনি। কিন্তু পুলিশ কথা বদল করেছে বারবার। লাশ পাওয়ার পর যখন মিডিয়াতে আমরা কথা বলছিলাম, তখন পুলিশের সুর নরম হয়।
উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবর ভোরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন রায়হান আহমদ (৩৪) নামের এক যুবক। পরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে তিনি মারা যান। রায়হান সিলেট নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি নগরীর রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করতেন। এই ঘটনায় ১২ অক্টোবর রাতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হেফাজতে মৃত্যু আইনে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। এই তদন্ত কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। এ মামলায় ২০ অক্টোবর মঙ্গলবার পুলিশ কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই। এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনমূখড় হয়ে পরে সিলেট। সিলেট মহানগর পুলিশকে নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এই সমালোচনার মুখে বুধবার (২২ অক্টোবর) মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে বদলি করা। আর এই ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত আকবর হোসেন ভূইয়া ১২ অক্টোবর থেকে পলাতক রয়েছেন। সূত্র : প্রথম আলো

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn