আতিক রহমান পূর্ণিয়া, হাওর অঞ্চল থেকে-

উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মাঝে ছোট একটা ডিঙি নৌকা নিয়ে মাঝ হাওরে ব্যস্ত চারজন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তারা মাছ ধরছেন। কাছে গেলেই ভুল ভাঙে। পানিতে ডুবে থাকা খড়ের তলে ডুব দিয়ে দিয়ে পচা ধানের মুঠি তুলে আনছেন তারা। তারা হলেন— ঝলক তালুকদার, নিরঞ্জন তালুকদার, কাকন সরকার ও গোবিন্দ দাস। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাওরের পাড়েই মল্লিকপুর তাদের গ্রাম। ঝলক ও নিরঞ্জন নৌকায় থেকে কাজ করছেন। কাকন আর গোবিন্দ ডুব দিয়ে ধান তোলার চেষ্টা করছেন। বিশ দিন আগেই নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিংগাপতা হাওরের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমি ডুবে গেছে। এতে কয়েক হাজার মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছে। তাতে ডুবেছে ঝলকদের এ বছরের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ঝলক জানান, দশফুট পানির নিচে যে জমি আছে সে জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন তিনি। এখন হয়তো ধান পাকতে শুরু করতো। এখন ঘরে ভাত নেই। তাই চারজন মিলে চেষ্টা করছেন পচা ধান তুলে তার থেকে যদি কিছু চাল বের করা যায়।

পচা ধানও আবার কাঁচা। ঝলক, নিরঞ্জন হাতে একটি ধানের শীষ তুলে বলেন, ‘এই যে দেখেন এই ধানের ছড়া থেইক্যা ঝাইড়া হয়তো পাঁচ ছয়টা ধান পাবো বড় জোড়। সারাদিন চারজনে কষ্ট কইরা যদি এক নৌকা ধান তুলতে পারি তাহইলে পঁচা ভালো মিলিয়ে দুই তিন মণ ধান হবে। সেই ধান চারজনে ভাগ করে নিবো। তাতে করে কয়েকটা দিন অন্তত খাওয়ার জোগান হইতে পারে।’

একবার ডুব দিয়ে উঠে গোবিন্দ বলেন, ‘কোনো কোনো সময় এক ডুবেও ধান হাতে পাই, কোনো কোনো সময় চার পাঁচ ডুবেও পাই না। এই যে চারটা মানুষ কষ্ট করতেছি এই ধান তো আর বেচা যাইবো না। যদি পেটের ক্ষুধাটা মরে। শুকাইলে, সিদ্ধা করলে এই ধানের ভাত খাইয়া কোনোভাবে থাকা যাইবো। বেচতে চাইলেও এই ধানের দাম আছে সাতশ টাকা মন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সূর্য হেলে। পানি থেকে গোবিন্দ আর কাকন বলেন, কষ্ট করমু, একমুঠো ধান পাইলেও নিতে চাই। এই দৃশ্য শুধু ডিংগাপোতা হাওরেই নয়। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জের অনেক হাওরে এখনো ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় পঁচা ধান সংগ্রহের চেষ্টা করছেন কৃষক। তাদের কারো ঘরেই খাবার নেই। এই ধানে যেই মানেরই চাল হোক না কেনো তাতে করেই দিন চলবে অনেকের।

কোথাও কোথাও আবার গভীর পানির নিচ থেকে পঁচা ধান সংগ্রহের স্থানীয় পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন কৃষক। রড দিয়ে ত্রিকোনাকৃতির একটি কাঠামো তৈরি করেছেন কৃষকরা। সেই কাঠামোর সাথে দড়ি বেঁধে গভীর পানিতে ছুঁড়ে মারছেন। অনেকটা নোংগর ধরনের এই কাঠামো দিয়ে ধানের ছড়া গেঁথে তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে নৌকায় করে পঁচা ধান সংগ্রহ করছেন কৃষক। স্থানীয়ভাবে এই পঁচা ধান সংগ্রহের পদ্ধতিকে বলা হয় গেরাফি। এভাবে গভীর পানি থেকে ধান সংগ্রহ খুবই কষ্টের ও সময়সাপেক্ষ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn