তসলিমা নাসরিন

ভারতের হিন্দুদের ‘বাবা কালচার’ বহু পুরোনো। গুরু শিষ্য কালচার থেকে আসা। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে বাবারা ব্যবসা করে। কিছু মাতাও গজিয়েছে। হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস প্রচণ্ড। এমন একটা পুরোনো ধর্ম! অজস্র রূপকথা। লক্ষ কোটি দেব দেবী। কাউকে মানলেও হয়, না মানলেও হয়। এই অঞ্চলের লোক একে মানে তো ওই অঞ্চলের লোক ওকে মানে। ধর্ম বিশ্বাস করায় বা ধর্ম পালন করায় কোনও জবরদস্তি নেই।নতুন প্রজন্মের হিন্দুদের নাস্তিক হওয়ার কথা। কিন্তু নাস্তিকের সংখ্যা এদের মধ্যে খুবই কম। দেবদেবী তো মানেই, অধিকাংশ হিন্দু কুসংস্কার মানে। আঙুলগুলোয় কুসংস্কারের পাথর। জ্যোতিষি ব্যবসা জমজমাট।বাবারা দেদার ঠকাচ্ছে সাদাসিধে মানুষকে। কত বাবা যে ভক্তদের দেওয়া টাকার পাহাড়ে বসে আছে, আর নিশ্চিন্তে কুকর্ম করছে।

সত্য সাঁই বাবা শুনেছি কচি কচি ছেলেদের রেপ করতেন, চারজনকে খুনও করেছেন। অদক্ষ হাতে ছোট ছোট যাদু দেখাতেন। যে কেউ ধরে ফেলতে পারবে হাতের কারসাজি। কিন্তু ধর্মে অন্ধ হয়ে থাকলে আঙুলের ফাঁকে রাখা ছাইয়ের বড়ি বিভূতিকে কায়দা করে বের করে নিয়ে বুড়ো আঙুলে ঘসে যে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের মাথায়, বিভূতি যে খালি হাতের ওপর আকাশ থেকে পড়েনি, অথবা অদৃশ্য ভগবান এসে দিয়ে যাননি- তা দেখা যায় না। সাঁই বাবা কাশি দিলেন, আর গলা দিয়ে সোনার ডিম বেরিয়ে এলো? সোনার ডিমটা যে বাবার তোয়ালের আড়ালে ছিল, যে তোয়ালে বার বার মুখের কাছে নিয়ে কাশছিলেন, তা অন্ধ না হলে ধরা যেত। সোনার চেইনগুলো যে পুরস্কারের বাক্সের তল থেকে আঙুল বাঁকিয়ে নিয়ে আসছিলেন, স্বয়ং ভগবান যে তাঁর হাতে দিয়ে যাননি ওগুলো, তা বিশ্বাসের অন্ধত্ব না থাকলে সবাই দেখতে পেতো। খুন ধর্ষণে ফাঁসবেন, আঁচ করে হাসপাতাল বানিয়ে ফেললেন। সমাজ সেবা কার টাকায় করেছিলেন? ওইতো মানুষের দেওয়া টাকায়।

আশারাম বাপু মেয়েদের ধর্ষণ করতেন। রাম রহিম তো হারেম খুলে বসেছিলেন। এঁরা নিজেদের ভগবান ভাবেন। এত বাবা ধরা পড়ছেন, তারপরও বাবার ওপর বিশ্বাস মানুষের যায় না। বিশ্বাস এমনই ভয়ঙ্কর।বিজ্ঞানে বিশ্বাস বাড়লে বাবায় বিশ্বাস কমবে। বিজ্ঞানে মানুষের বিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। টেলিভিশনে কটা চ্যানেল বিজ্ঞানের, কটা ধর্মের! ধর্মেরই তো দেখি সব। ধর্মে বিশ্বাস কমলে বাবা-ব্যবসা বন্ধ হবে। কী বলবো, ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানী মন্দিরে ছোটেন ভগবানের কৃপা পেতে। মানুষকে বিজ্ঞানমনষ্ক করতে কত হাজার বছর আরও দরকার, জানিনা।বাঙালি মুসলমানের পূর্ব নারী-পুরুষ হিন্দু। সম্ভবত হিন্দুর এই ‘বাবা কালচার’ থেকেই এসেছে মুসলমানের ‘পীর কালচার’। হিন্দুরা বাবা নিয়ে যে আদিখ্যেতা করে, মুসলমানরা পীর নিয়ে অনেকটা তাই করে।

পীর ফার্সি শব্দ। পীর অর্থ বুড়ো লোক। কোনও কোনও সুফি যাঁরা আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিক্ষা দিতেন, তাঁদের পীর বলা হতো। সুফি পীর মারা গেলে মাজার বানানো হতো। এখন তো ভণ্ড কিছু সুন্নি লোক মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে মূলধন করে পীর ব্যবসায় নেমে পড়ে। বাবাদের ভক্ত যেমন মিনিস্টার, ক্রিকেটার, কালাকার। পীরের মুরিদও তেমন। দেশের প্রেসিডেন্ট অবধি দৌড়োন পীরের অনুগ্রহ পেতে। বড় বড় রাজনীতিকরা, ধনকুবেররা, বাবা আর পীরের পায়ের ধুলো নিতে ব্যস্ত থাকেন বলে বাবা আর পীরের দাম বেড়ে আকাশে ওঠে। বাবা প্রতারণা করেন, পীরও তাই করেন। এই প্রতারকদের কবলে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমান। পীরে, হুজুরে, ভরে গেছে বাংলাদেশ। বাঙালি মুসলমানদের নষ্ট হওয়ার পেছনে এরা অনেক বড় কারণ। এরা জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। দেশজুড়ে ওয়াজ করছে আর নারী বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। ইসলাম নাকি বলে আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নোয়াবে না। অথচ মুসলমানেরা পীর হুজুরের পায়ে মাথা নোয়াচ্ছে। ভক্তরা যেমন রাম রহিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই খবর পেয়ে হরিয়ানার শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভক্তরা দেলাওয়ার হোসেইন সাইদি নামের এক পীরের ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর একই রকম আগুন জ্বালিয়েছিল গোটা বাংলাদেশে। ধর্ম ব্যবসাটা বন্ধ না করলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

তসলিমা নাসরিন, লেখক ও কলামনিস্ট।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn