এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবার আগে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনায় দুই ধরনের সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে আইনগত বা শাসনতান্ত্রিক সংস্কার তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর নগ্ন ও সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনের সংস্কারই যথেষ্ট নয়, নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কেও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে এসব কথা লিখেছেন। এই বইয়ে ড. খান আরো লিখেছেন, তাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে চার ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব: ১. যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান। ২. সংবিধান সংশোধন করে দুই মেয়াদের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। ৩. সংবিধান সংশোধন করে তিন মাস মেয়াদের জন্য নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। ৪. সংবিধান সংশোধন না করে নির্বাচনের আগে সর্ব-দলীয় সরকার ব্যবস্থার রীতি প্রবর্তন।
আকবর আলি খান আরো লিখেছেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তার তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ব্যতিক্রম করা হয়েছিল বাংলাদেশে। এরপর পাকিস্তানেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। তবে এ ধরনের অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচন সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো যে গণতান্ত্রিক দেশে কোনো অনির্বাচিত সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া যায় না। তবু বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথম কারণ হলো যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো ‘অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে’ দেশ পরিচালনার শাসনতান্ত্রিক শপথ রক্ষা করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এরা প্রশাসনযন্ত্রকে বাধ্য করে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একটি অতিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এখানে শুধু একটি সরকারই রয়েছে; কোনো প্রাদেশিক সরকার বা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার নেই। এই কেন্দ্রীভূত সরকারের সব ক্ষমতার উৎস হলেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যত ক্ষমতা রয়েছে, সে ধরনের ক্ষমতা পৃথিবীর খুব কম দেশেই সরকারপ্রধানদের রয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এর ফলে এখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে নির্বাচন হলে অনেক সময়ই নির্বাচনের গ্রহণয্যোতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দ্বিতীয় ব্যবস্থা হতে পারে আগামী দুই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা বহাল করা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। তবে স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশের বিশেষ প্রয়োজনে আগামী দুই নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংসদ ইচ্ছে করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রচলন করতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিস্তারিত রায়ে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তাতে এই ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা অত্যন্ত শক্ত হবে। উপরন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই ব্যবস্থা চালু করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক সমাধান খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কাজ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।
তৃতীয় সমাধান হতে পারে সংবিধান সংশোধন করে সংসদ কর্তৃক তিন মাসের জন্য নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে বিভিন্ন ফর্মুলা দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। এই ব্যবস্থার সুবিধা হলো, এই সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো এই সমাধানে রাজি হবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে।
চতুর্থ ব্যবস্থা হতে পারে নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় সরকার গঠন করা। এ জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হলেই সর্বদলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। তবে সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলেও বর্তমান বিধি অনুসারে এই সরকার হবে মূলত প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার। এর ফলে এ ধরনের সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটুকু সফল হবে, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। তবে সংবিধান সংশোধন না করেও এই ব্যবস্থায় দুটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রথমত, বর্তমান কার্যবিধিমালায় সরকারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা রয়েছে। কার্যবিধিমালা সংশোধন করার জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী সুপারিশ করলে এবং রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করলে কার্যবিধিমালা সংশোধন করা সম্ভব। সর্বদলীয় সরকার নির্বাচনকালীন সে সরকারকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কার্যবিধিমালায় শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষেত্রে তিনটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে। ১. মন্ত্রিসভার সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হতে হবে। যদি একজন সদস্যও কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন, তাহলে নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, কার্যবিধিমালায় সরকারি কর্মচারিদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিধান করা যেতে পারে যে নির্বাচনকালীন সরকারে সব নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন লাগবে। তৃতীয়ত, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। একই ব্যক্তির পক্ষে দল পরিচালনা করা এবং সরকার পরিচালনা করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না; এসব ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা থাকতে পারবেন না, এ ধরনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা হতে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন শেষে আবার সংঘাতের রাজনীতিতে ফিরে যায়। যারা নির্বাচনে হারে, তারা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন তুলতে থাকে। কিন্তু কোনো সরকারই সংস্কারের পথে পা বাড়ায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য অবশ্যই নির্বাচনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানই রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের বড় কোনো রাজনৈতিক দলই বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কারে বিশ্বাস করে না। তাদের নির্বাচনী ওয়াদার মধ্যে ওপরে উল্লিখিত রাজনৈতিক সংস্কারসমূহের কোনো উল্লেখ নেই।
সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়াও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য দুটি উপাদান প্রয়োজন। প্রথমত, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক কর্মী রয়েছে। এদের বেশির ভাগই স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাজনীতিতে অংশ নেয়। আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা সীমিত। আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীরা বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস করে না, যারা বিশ্বাস করে তাদের অনেকেই চরমপন্থি। বাংলাদেশে অর্থবহ রাজনৈতিক সংস্কার করতে  হলে তাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী বাড়াতে হবে। অতীতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর বারবার হামলা এসেছে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এসব হামলা প্রতিহত করেছে। যদি গণতন্ত্রের সুফলসমূহ জনগণের কাছে তুলে ধরা যায়, তাহলে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব।মানবজমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn