বার্তা ডেস্ক :: করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের কঠোর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে লাপাত্তা প্রায় পৌনে চার লাখ বিদেশফেরত। তাঁরা না ছিলেন বাসায়, না ছিলেন সরকারের তত্ত্বাবধানে। কিভাবে এমনটা হয়েছে বলতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অথচ সরকারের নির্দেশনা অনুসারে যাঁরাই বিদেশ থেকে দেশে ঢুকবেন তাঁদের অবশ্যই কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে নিজ নিজ বাসায় কিংবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতায়, যাঁদের সবাইকে নজরদারি করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখান থেকে যদি কারো উপসর্গ দেখা যায় কিংবা পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট আসে তবে তাঁদের আইসোলেশনে থাকতে হবে সংক্রমণ বিস্তার ঠেকানোর প্রথম উপায় হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা দেশে এখনো সংক্রমণ বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিদেশফেরতদের কথাই বলছেন। কিভাবে এত বিদেশফেরত মানুষ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করলেন, সেটা নিয়েও বিস্মিত অনেকেই। এর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাফিলতিকেই দুষছে সবাই। এখনো দেশের বাইরে থেকে আসা মানুষের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণ বিস্তার ঘটছে—এমন তথ্য দিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গত বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক অনুষ্ঠানে একই সুরে বলেছেন, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে দেশে ঢুকছেন।

সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, ‘যাঁরা যেভাবেই দেশে প্রবেশ করুন না কেন সবাইকেই আমাদের হিসাবের মধ্যে কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। সেটা ঢাকায় কিংবা ঢাকার বাইরে যেকোনো জায়গায়ই হোক না কেন। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তি যদি যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানকার করোনা নেগেটিভ কাগজ দেখাতে পারেন তবে তাঁদের বাসায় কোয়ারেন্টিনের পরামর্শ দেওয়া হয়। যাঁরা এই কাগজ দেখাতে পারেন না তাঁরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। যাঁরা বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকবেন তাঁরাও আমাদের মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকবেন গাইডলাইন অনুসারে। এর ব্যত্যয় হওয়ার কথা নয়। সব বন্দর ও স্থানীয় সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত বিমান, নৌ, রেল ও সড়ক পথে দেশে প্রবেশ করেছেন আট লাখ ৬১ হাজার ৯৬৩ জন। কিন্তু কোয়ারেন্টিনসংক্রান্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশে ছিলেন বা বিদেশ থেকে এসেছেন—এমন সব মিলে কোয়ারেন্টিনে গেছেন মোট (গতকাল পর্যন্ত যাঁরা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন তাঁদেরসহ) চার লাখ ৮৮ হাজার ৮২৩ জন। এর মধ্যে হোম কোয়ারেন্টিনে চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৬১ জন ও সরকারি বা অন্যান্য জায়গায় কোয়ারেন্টিন করেন ২৯ হাজার ৯৬২ জন। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ৫২ হাজার ৪০৫ জন, বাকিরা কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ শেষ করেছেন। অর্থাৎ বাকি তিন লাখ ৭৩ হাজার ১৪০ জন বিদেশ থেকে দেশের সীমানায় ঢুকে কিভাবে কোথায় গেলেন তার কোনো হদিস নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারেই গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে চারটি মাধ্যমে দেশে ঢুকেছেন তিন হাজার ৩১৩ জন। এর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৮১১ জন কোয়ারেন্টিনে গেছেন; এক হাজার ৬৯৬ বাসায় ও অন্যান্য স্থানে ১১৫ জন। এ হিসাবে বাকি এক হাজার ৫০২ জন বিদেশ থেকে আসা লোক কোথায় গেলেন তার খোঁজ নেই। যদিও এই সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। কারণ প্রতিদিন যাঁরা কোয়ারেন্টিনে ঢোকেন তাঁদের মধ্যে একটা অংশ আগে থেকেই দেশে ছিলেন যার আলাদা হিসাব পাওয়া যায় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মিলিত তথ্যে। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি খুঁজে দেখছি। যাঁরা এর দায়িত্বে আছেন তাঁদের ডাকা হয়েছে।’রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন  বলেন, ‘আমাদের দেশে সংক্রমণ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটি ঘটেছে ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন অনুসরণ করতে না পারা। বিদেশ থেকে যাঁরা আসেন তাঁদের যেমন কোয়ারেন্টিন করা গেল না, তেমনি দেশের ভেতরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে যাঁদের কোয়ারেন্টিন দরকার ছিল সেটা করা হয়নি। ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না প্রত্যাশিত মাত্রায়।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে যাঁরাই দেশে ঢুকবেন তাঁরাই কোয়ারেন্টিনে যাবেন, এর কোনো বিকল্প নেই। এটা যদি না হয়ে থাকে তবে বিপদ আরো বড় হয়ে আমাদের জাপটে ধরবে। আর কেনই বা এটা করা হলো না বা হচ্ছে না, সেটা বোধগম্য নয়। হয়তো পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জায়গায় গলদ ছিল বা আছে বলেই এমনটা হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, বন্দরগুলোতে অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা উচিত। যেখানে ১৫ মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। ডা. বে-নজীর বলেন, একটি বিমানে যদি এক শ যাত্রী আসেন, তাঁদের মধ্যে যদি দুজনও আক্রান্ত থেকে থাকেন তবে সবাইকেই কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে। যাঁরা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন তাঁরাও ওই দুজনের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn