বলা হয়ে থাকে, ‘বিশ্বাসে টলে পাহাড়।’ যখন আমাদের পাহাড় সরানোর দরকার হয়, তখনকার জন্য এটা হলো উৎসাহজনক বিশ্বাস। কিন্তু আমাদেও দৈনন্দিন জীবনে যুক্তি বাদ দিয়ে প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীলতা আলোকিত জীবনে (আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধ  যেভাবে আলোচনা করেছিলেন) পরিচালিত হওয়ার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া যুক্তি-তর্ক এবং মতবিনিময়ের ফলে যুদ্ধ এবং রক্তপাতও প্রতিরোধ করতে পারে। তারপরও স্বীকার করতে হবে, ভালো বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন অনেক অর্জন (এই যেমন দান সংগ্রহ এবং লোকহিতৈষী কাজ) সম্ভব। কিন্তু সাধারণভাবে এটা অন্যদের কথা শোনার আগ্রহকে নিরুৎসাহিত করে। আর খারাপ বিষয়ে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে নির্দয়তা ও হত্যাকাণ্ড।

মধ্যযুগে বিশ্বাসভিত্তিক ইনকুইজিশন ইউরোপকে পাঁচ শ’ বছরেরও বেশি সময় অন্ধকাওে রেখেছিল। বিরোধী মতের লোকজনকে শাস্তি প্রদান এবং অপরাধীকে হত্যা করাকে তারা কর্তব্য মনে করতো। আমি বলার চেষ্টা করছি, ভারতের বিশেষভাবে যুক্তিভিত্তিক সংস্কৃতি থাকার  সৌভাগ্য ছিল। ভারতীয়দের যুক্তির প্রতি আগ্রহের কারণে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করতো, বিতর্ক ও আলোচনা সহিংস সঙ্ঘাতকে সংযত করতো।

ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় ছিল ভারত। প্রথম থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত খ্রিস্টানদের হয়রানির শিকার ইহুদিদের, সপ্তম শতকের শেষদিকে পলায়নপর পারসিক এবং ১৯ শতকে নির্যাতিত বাহাইদের আশ্রয়, নতুন বাড়ি দেয়া হতো।

ভিন্ন মতের প্রতি ভারতের সহিষ্ণুতা কি এখনো আছে? আমরা যদি আজকের ভারতের দিকে তাকাই, দেখব যে সহিষ্ণুতার লক্ষণগুলো দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হবে। যে দেশ পলায়নপর নির্যাতিত লোকজনকে স্বাগত জানাত, অভিবাসী সংখ্যালঘুদের নিজেদের বিশ্বাস ও প্রথা বজায় রাখার সুযোগ (এবং খাদ্য ও বাসস্থান) দিত,  সেই দেশ এখন গরুর গোশত খাওয়া মানুষ শিকারী বুনো দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য হয়ে পড়েছে, তারা  লোকজনকে (খুবই গরিব লোকজন) হত্যা করছে। চামড়া শিল্পে এসব লোকের চাকরি গরুর পবিত্রতায় বিশ্বাসী লোকজনের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করছে।

একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সংস্থা সাহস করে তার প্রকাশিত খবরে এ তথ্য দিয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকার পছন্দ করছে না যে তার প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বিশেষ নজিরবিহীন মান হানিকর অভিযোগ থাকুক (এনডিটিভি এ নিয়ে আপনাকে কিছু বলতে পারে, যদি কেবল খবরের জন্য খবরের সন্ধান না করেন)।

ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচে আপনি কোন দলকে সমর্থন করবেন, তার ভিত্তিতে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অবিশ্বাস্য অভিযোগ এনে পুলিশি হেফাজতের ব্যবস্থা করতে পারে। অথচ এটা সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্টভাবে দেয়া নিদের্শনার পরিপন্থি। কারণ কোনো ধরনের অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যায়, তা সুস্পষ্টভাবে বলে  দেয়া হয়েছে। পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আসছে অহরহ। এতে করে কৃত্রিম আইনি-প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসের সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকন্তু, আপনি  হেফাজতে নিয়ে প্রহারও করতে পারেন (ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারকে জিজ্ঞাসা কওে দেখুন। তার বিরুদ্ধেও অবিশ্বাস্যভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল)।

ভারতের সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য চাপা দিতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি স্পষ্টতই বিপুল ভূমিকা পালন করছে। অবাক করা বিষয় হলো, ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় অসহিষ্ণুতার সহিষ্ণুতা কতটা বহন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

মনে হবে, অবচেতন লোকজন ঘোর লাগা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। অধিকন্তু, স্পষ্টত উদার বুদ্ধিসম্পন্ন অনেক লোক কোনো না কোনো কারণে (এই যেমন নরেন্দ্র মোদির সংস্কার থেকে সুবিধা লাভের আশা করছে। যেটাকে আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট অভিহিত করেছে ‘সংস্কারের বিভ্রম’ হিসেবে) সরকারকে সমর্থন করা অব্যাহত রেখেছে। অথচ দেশ অসহিষ্ণুতা ও পরাধীনতার মই বেয়ে নিচের দিকে কেবল নামছেই।

আমাদের স্বীকার করতে হবে, বিশ্বাস ও অনুশীলনে ভারতীয় সমাজ যে স্বাধীনতাগুলো উপভোগ করে আসছিল, সেগুলো রক্ষা করতে হবে, সহায়তা দিতে হবে। নির্বুদ্ধিতা সংশোধন এবং সেগুলোর পুনরুত্থানের জন্য লঙ্ঘনের অবশ্যই বিরোধিতা করতে হবে। বস্তুত ভারত ১৯৪০-এর দশকে মারাত্মক সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় ব্যাপক রক্তপাত দেখেছে। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা তাদের ভিশন ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতিরোধের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন ছাড়াও সামপ্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, ব্যক্তিগত বিপুল আত্মত্যাগ করেছেন, ব্যাপক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি তার জীবন দিয়ে লড়াই চালিয়েছিলেন এবং জিতেছেন।

এই মুহূর্তে আমাদের কাছে গান্ধীজির (কিংবা জওয়াহের লাল নেহারু) মতো নেতৃত্ব নেই। আমাদের সামনে জয়প্রকাশ নারায়ণের মতোও কেউ নেই। কিন্তু বিরোধী দল কি ভারতের সেক্যুলার ও সহিষ্ণু ঐতিহ্য ধ্বংস ঠেকাতে আরো জোরালো প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারত না? মজার ব্যাপার হলো, ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে এখনকার চেয়ে অনেক কম সামপ্রদায়িক উসকানির মুখেও আরো জোরালো প্রতিরোধ ছিল। কংগ্রেস সুচারুভাবে চয়ন করা এবং দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা সেক্যুলার কৌশলের ফল বেশ ভালোভাবেই পেয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয় তারা অনেকটাই বদলে গেছে, স্থবির হয়ে পড়েছে।

ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দূরদর্শীসম্পন্ন প্রার্থী উপস্থাপনের বদলে বিজেপিকেই প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জড়গ্রস্ত হয়ে বসে থাকে। মহাত্মা গান্ধীর ঐতিহ্যের উত্তরসূরি কংগ্রেস জাতীয় আবেদন নিয়ে বুদ্ধিমত্তা-প্রসূত কৌশল গ্রহণ করতে পারতো। গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর নাম ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। তিনি মহান বুদ্ধিজীবী এবং ভারতের সঠিক ভিশন সম্পর্কে প্রাণবন্ত রাজনৈতিক আলোচনা করার শক্তি ধারণ করেন। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, তিনি কংগ্রেসের বর্তমান চিন্তাধারার সঙ্গে মানানসই নন।

তাকে বাছাই করার বদলে কংগ্রেস বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল গ্রহণ না করে যুদ্ধ করার ছল-চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করেছে, বিজেপিকে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছে। আর আবারো বিজেপি প্রমাণ করল, কংগ্রেসের চেয়ে তারা অনেক বেশি স্মার্ট। (বিষয়টি চলতি বছরের প্রথম দিকে গোয়া ও মণিপুর রাজ্যে অনুষ্ঠিত রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনেও দেখা গেছে। উভয় রাজ্যে বিজেপি’র চেয়ে কংগ্রেস বেশি আসন পেয়েছিল। কিন্তু স্মার্ট ও দ্রুত জোট গঠন করে উভয় রাজ্যেই সরকার গঠন করে বিজেপি।)

বিজেপি রাম নাথ কোবিন্দের নাম ঘোষণা করার পর অনুকরণমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কংগ্রেস তাদের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মিরা কুমারের নাম প্রস্তাব করে। তার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ভিশন আছে এবং সেইসাথে আছে দলিত পরিচিতি। কংগ্রেস সুপরিকল্পিত কৌশল হিসেবে তার নাম যদি আগেই প্রস্তাব করে বসত, তবে তিনি এই বিলম্বিত মনোয়নের ফলে যত ভোট পাবেন, তার চেয়ে বেশি ভোট পেতে পারতেন। কারণ বিজেপি তার নিজস্ব দলিত প্রার্থীর জন্য ইতোমধ্যেই দ্রুত সমর্থন জোগাড় করে ফেলেছে।

ভারতকে এখন যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে সেটা হলো কৌশলগত সমর্থন-সংবলিত ভিশনের। এখানে অতি-ধূর্ত বা একীভূত দৃষ্টিভঙ্গিহীন কিছুর দরকার নেই। বিশেষ করে গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা এবং সবার প্রতি সমান আচরণ করার ভিশনও যুক্তি-সমর্থিত সুবিশ্বাসের শক্তিশালী বাহন হতে পারে। যুক্তিকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত পথে উপলব্ধি করতে হবে, ভারতের অতীত ও ভবিষ্যৎ উভয়টিকেই দেখতে হবে এবং তাতে জনগণের লালিত হতে হবে। ভিশনমূলক কৌশল এমনভাবে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য আদায় করতে পারে, যা নির্বোধ, যা নির্বোধ ছল-চাতুরি সামান্যই আশা করতে পারে। যদি এটা পরিবর্তনের মতো শোনায়, তবে তা ঠিক তা-ই বিবেচিত হতে পারে।

[লেখক: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী; অধ্যাপক, অর্থনীতি ও দর্শন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়]
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn