এ কে এম আতিকুর রহমান:: গত ২৮ মে ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের এক সরকারি সফরে জাপান যান। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়াও তিনি জাপান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম ও ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯৯৭, ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে জাপান সফর করেন।  আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দুই দেশের জন্য লাভজনক ক্ষেত্রগুলোতে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে দুজনই একমত পোষণ করেন। আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা নিয়ে আলোচনায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে জাপানের সহায়তার আশ্বাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণসহ অন্যান্য বিষয়ে দুই দেশ একে অপরের প্রতি সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেন। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা করা হয়। জাপান রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে বিশ্বাসী এবং এ জন্য মিয়ানমারে তাদের ফিরে যাওয়ার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে। এ বিষয়ে জাপান সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে থাকার নিশ্চয়তা দেয়।

জাপানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, আনুমানিক ১০-১১ হাজার হবে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেওয়ার ব্যাপারে দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে একটি দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্যও জাপানকে অনুরোধ করা হয়। জাপান ইতিবাচক সাড়া দিয়ে এ বিষয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণে সম্মতি প্রকাশ করে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় নেতা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সংগ্রামে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালের জুনে ঢাকায় হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছিল। আমরা জানি ওই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে সে ব্যাপারে দুই দেশই জরুরিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। বর্তমান সফরে যৌথভাবে সন্ত্রাসকে মোকাবেলা করার অঙ্গীকার আরেকবার ব্যক্ত করা হলো। এ ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিহত নাগরিকদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরপরই দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের একটি উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৪০তম সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) প্যাকেজ চুক্তির অধীনে এ অর্থ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) উন্নয়ন প্রকল্প (লাইন-১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প (৫)-এ ব্যয় করা হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাপানের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী। গত বছরও বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) হিসেবে ১.৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে জাপানি ওডিএ এসেছে ১১.৩ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে জাপান থেকে সবচেয়ে বেশি ওডিএ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য পূরণে জাপান বাংলাদেশকে অব্যাহত সহযোগিতা করে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৯ মে সকালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের বৈঠকেও যোগদান করেন। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের বাণিজ্যক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত ও সুদৃঢ় করার জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জাপানি ব্যবসায়ীদের আরো অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য, জাপান বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের বড় ১০টির মধ্যে একটি। বাংলাদেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ এখনো বেশি, যদিও প্রতিবছর রপ্তানির পরিমাণ আমদানির অনুপাতে আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া ২৬০টির বেশি জাপানি কম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। অর্থাৎ জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণও কম নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ মে টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ওই সম্মেলনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ছাড়াও অংশ নেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এবং ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। বিশ্বকে কিভাবে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে এশিয়ার দেশগুলোর সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা যায় সে বিষয়ে তিনি পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাবগুলোতে মূলত বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো একত্রে মোকাবেলা করাসহ স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার সুরক্ষা করার মাধ্যমে বিশ্বকে শক্তিশালী করা; অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অংশীদারি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সবার সমান সুবিধা কৌশল গ্রহণ; পরস্পরের সাহায্যে সবারই সমানভাবে এগিয়ে আসা; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই ও সমতাভিত্তিক উন্নয়ন করা এবং সব ক্ষেত্রের উন্নয়নে গতিশীলতা আনার জন্য যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার কথাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ সংলাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায় বলে উল্লেখ করেন।  

জাপানের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই। আর সেই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়িত হয় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ তারিখে, যেদিন জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর পরই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের গোড়াপত্তন ঘটে। জাপানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফরটি করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু টোকিওতে তাঁর সম্মানে বাংলাদেশ-জাপান সমিতির দেওয়া ভোজসভায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আপনারা যে সাহায্য ও সহায়তা দিয়েছেন, তা ছিল আমাদের শক্তির উৎস। আপনাদের দেওয়া সেই সাহায্য-সহানুভূতি বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের জনগণ ও তার সমস্যা সম্পর্কে জাপানের জনগণ ভালোভাবেই জানে। তাই স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আপনারা সমবেতভাবে বিভিন্ন মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আপনাদের এসব মহান কার্যক্রম দুই দেশের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সহায়ক হয়েছে। আর এ বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই হচ্ছে আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য।’ সেদিন দুটি দেশ ও তাদের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি এভাবেই রচিত হয়েছিল। আর আজ সেই সম্পর্কের ছোট চারাটি জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পরিণত হয়েছে এক মহীরুহে।

আমরা একসময় প্রাচ্যমুখী নীতির (লুক ইস্ট পলিসি) কথা শুনতাম। এশিয়ার দুটি দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছিল সেই নীতির কেন্দ্র। জাপান থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। সেখানে আমাদের দক্ষ কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা যদি জাপানে আমাদের মেধাবী ছাত্রদের পাঠিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ও অন্যান্য উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল শিখিয়ে আনতে পারি, তা আমাদের অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতিকে শুধু শক্তিশালীই করবে না, এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমে যাবে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

নানা কারণেই জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। জাপান আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আসছে। আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অবকাঠামো বিনির্মাণে জাপানের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান চুক্তির পর সে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি এ অর্থ বাংলাদেশের উন্নয়নে আরো গতি আনবে বলে আশা করি।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় জাপানের সমর্থন ও সহযোগিতা অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এ ব্যাপারে চীন বা রাশিয়া, এমনকি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য জাপানের সহযোগিতার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। শেখ হাসিনার বর্তমান সফরটি অবশ্যই দুই দেশ ও তাদের জনগণের সম্পর্ককে বিশ্বস্ততার, বন্ধুত্বের, অংশীদারির, উন্নয়নের ও সহযোগিতার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে আরো বিস্তৃত, শক্তিশালী ও বহুমুখী করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সফরটি নিয়ে পাঁচবার জাপান সফরে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো একটি দেশে পাঁচবার দ্বিপক্ষীয় সফরে যাওয়া বিরল ঘটনা। সে ক্ষেত্রে তাঁর পাঁচবার জাপান সফর এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের কাছে জাপান কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা দুই দেশের সম্পর্ক কতটা গভীর। সেই প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সফরটি নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী ও বিস্তৃত করার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn