প্রবাসী আয় আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
বিদেশ থেকে পাঠানো প্রবাসীদের আয় গত আট বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। গত ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আশংকাজনক হারে কমে গেছ দেশে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্য। দেশগুলো থেকেও রেমিটেন্সের পরিমাণ কমেছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কমেছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ ১০ হাজার ৯৮৭ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার ছিল। এরপর থেকে প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে এ আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সমাপ্তপ্রায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হঠাৎ প্রবাসী আয় কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৮৭ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলারে। যা গত আট বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন। এ হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় আয় কমেছে চার হাজার ৬৫২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দা, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কমে যাওয়া, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে জটিলতা, শ্রম ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এ বছর প্রবাসী আয় কমেছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় ছিল ১৪ হাজার ৯৩১ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হঠাৎ প্রবাসী আয় কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ২৮৭ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর ডলারের বিপরীতে টাকার অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু এ বছর প্রবাসীরা ডলারের দাম খুব বেশি একটা ভালো পাননি। আর ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী আয় কম হওয়ার মূল কারণ এ দুটো। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে যে খরচ হয় তা খানিকটা বেশি। এছাড়া কম টাকা পাঠাতে যে খরচ দিতে হয় বেশি টাকা পাঠাতেও একই খরচ দিতে হয়। তাই বাড়তি খরচ এড়াতে অনেকে হুন্ডির পথ বেছে নিচ্ছেন। ডলারের বিনিময় হার যাতে প্রবাসীদের অনুকূলে থাকে সেদিকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেয়াল রাখা উচিত। পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং খরচ কমানো প্রয়োজন।
তথ্যানুসারে, প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। সমাপ্তপ্রায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশটি থেকে পাঠানো প্রবাসী আয় গত দশ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম ছিল। এ বছর সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা এক হাজার ৮৪৩ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার ১১২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার কম।
সৌদি আরব থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন দুই হাজার ৯৫৫ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এ আয় ছিল এক হাজার ৭৩৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার এবং এরও আগের অর্থবছর (২০০৫-০৬) ছিল তিন হাজার ৩৪৫ দশমিক ২২ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের আরেক প্রধান শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও পাঠানো প্রবাসী আয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিগত নয় বছরের তুলনায় কম হয়েছে। এ বছর এক হাজার ৩২৮ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। গত অর্থবছর ছিল দুই হাজার ৭১১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরাও এ অর্থবছরে গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম এক হাজার ৬১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, নন ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা আসার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবাসী আয় কমেছে। বাস্তবে মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে প্রবাসী অর্থ ঠিকই আসছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা বলেন, সম্প্রতি টাকার বিপরীতে পাউন্ড, ইউরো ও রিয়ালের দাম কমে গেছে। এ কারণে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়ে টাকা কম পাচ্ছেন। তারা এখন টাকা নিজেদের কাছে ধরে রাখছেন, ডলারের দাম বাড়লে পরে পাঠাবেন বলে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি হুন্ডির প্রবণতাও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নন ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেসব রেমিটেন্স আসছে তার বেশির ভাগই হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টা রয়েছে।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কট তৈরি হতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রবাসীরা সব সময়ই তাদের কষ্টার্জিত অর্থের ভালো দাম পেতে চাইবে। সেই সঙ্গে ঝামেলা এড়িয়ে যত সহজে অর্থ দেশে পাঠানো যায় সে চেষ্টাও করবে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাই সরকারের উচিত হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া। কারণ, হুন্ডির কারণে রেমিটেন্স যেমন কম হচ্ছে তেমনি দেশের বাইরেও অর্থ চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে প্রবাসীরা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। যে কারণে তাদের আয় রোজগারে ব্যাঘাত ঘটছে। এ অবস্থা কেটে গেলে প্রবাসী আয় আবার আগের মতো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর পদ্ধতি আরও সহজ করা উচিত।