মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী লিয়াকত আলী

প্রায় সময় অতি আগ্রহে বাবাকে বলতাম মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা শুনানোর জন্য। তখন বাবা শুনাতেন যুদ্ধের কথাগুলি। যা শুনলে ভয়ে শরীর শিরশিরি দিয়ে কেঁপে উঠে :-বাবা বললেন, আমরা দুই ভাই আলী হায়দার ও আমি একসাথে স্কুলে যেতাম। তখন দেখতাম আমার বাবা (মরহুম আসকর আলী) অন্যায়ের প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। ঝাওয়ার হাওরে কৃষকদের জমি চাষ করার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে একাট্্রা হয়ে সারাজীবন লড়েছেন। একসময় তিনি এই আন্দোলনে কৃষক বন্ধু কমরেড বরুণ রায় এবং মেহনতি মানুষের বন্ধু আলফাত উদ্দিন মুক্তার সাহেবকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তখন থেকে পারিবারিক ভাবে পাওয়া বিদ্রোহী মন কাজ করত। তারপর থেকেই আন্দোলন, সংগ্রামে সবার আগে থাকতাম। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চলছে। শহরের সব জায়গায় থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এর ছবি ভাঙ্গা হচ্ছে। তখন আমি সিনিয়র নেতাদের সাথে মিছিলে, মিটিংয়ে সামিল হয়ে ছবি ভাঙ্গতে ব্যস্ত। সুনামগঞ্জ শহরে কিছু দোকান ছিল যেগুলোর সবাই এক নামে আমায় চিনতো। তার মধ্যে মিউনিসিপ্যালিটির মেম্বার রফিক আহমেদের একটি আছিয়া স্টোর ছিল। সেই আছিয়া স্টোর থেকে আইয়ুব খানের ছবি নামিয়ে ভেঙ্গেছিলাম। আমার প্রতিবাদী মন মেজাজের জন্য লেখাপড়া বেশি দূর চালিয়ে যেতে পারিনি।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনীয় প্রচারনায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম “দেওয়ান ওবায়দুর রাজার”পক্ষে। মঙ্গলকাটা, সৈয়দপুর, হালুয়ারগাঁও এলাকায় ব্যপক কাজ করতাম। ঐ নির্বাচনে “দেওয়ান ওবায়দুর রাজার” পাস করেন। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সবাই আঁচ করতে পেরেছিলাম যে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তখন থেকে শহরের মানুষ জন গ্রামে যাওয়া শুরু করেন। যে যেভাবে পারছেন নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। সেই সময় পাঞ্জাবীরা সুনামগঞ্জে প্রথম আসা শুরু করে তখন আমি, মোছাদ্দেক রেজা, সাধন ভদ্র, সালেহ, খসরু, সকল বন্ধুরা মিলে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা মারতাম, আর কিভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা যায়, কোন কাজটি কিভাবে করলে ভালো হয় তা নিয়ে মত বিনিময় করতাম হোসেন বখ্ত চত্ত¡র (বক পয়েন্টে)।
আমাদের বাসার পাশে ছিল বাঙ্গালী ইপিআরদের ক্যাম্প। তখন বাঙ্গালী ইপিআর, সুবেদার একজন পাঞ্জাবীকে হাত-পা বেঁধে ক্যাম্পে ফেলে রাখে। ইপিআররা জানতো আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমাকে সুবেদার খবর পাঠালেন রাতে তাদের ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য। আমি রাতে গেলাম, গিয়ে দেখি পাঞ্জাবী লোকটিকে তারা হাত, চোখ ও মুখ বেঁধে রেখে দিয়েছে। আমি যেতেই আমাকে চলো বলেই পাঞ্জাবী লোকটিকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে আসলো ঝাওয়ার চরে। সেখানে এসে দেখি একটি গর্ত করা। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে যাই। পরে সুবেদার আমার হতে একটি বেয়োনেট ধরিয়ে পাঞ্জাবী লোকটিকে গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে বলছে পাঞ্জাবী লোকটিকে মারার জন্য। তখন ছিল চাঁদনী রাত। জীবনে কখনও মানুষ মারিনী, কি করে যে মারব, তারপরও চিন্তা করলাম পাঞ্জাবীরা আমার শত্রæ, দেশের শত্রæ বাঙ্গালী জাতির শত্রæ, পরে আমি এবং সুবেদার লোকটিকে মেরে গর্তে ফেলে দেই। তখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর। এই ঘটনার ১/২ দিন পরই ট্রেনিং এর জন্য ভারত চলে যাই। ইকোওয়ানে ১ মাস ট্রেনিং দেই। আমাকে গেরিলা ট্রেনিংও দেওয়া হয়। ট্রেনিং এর পাশাপাশি আমাদের এই শিক্ষাও দেওয়া হয় যে সহকারী কোন যোদ্ধা যদি আহত হয় তাকে তাৎকালীন চিকিৎসা দিয়ে যতটুকু সম্ভব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা এবং সময় সুযোগ বুঝে সেই আহত যোদ্ধাকে ক্যাম্পে নিরাপত্তার সহিত নিয়ে আসা, আর যদি কোন যোদ্ধা শহীদ হয় তাহলে সেই শহীদের মৃতদেহ যে কোন উপায়ে ক্যাম্পে নিয়ে আসতে হবে আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে যে কোন নিদির্ষ্ট স্থানে সেই শহীদ যোদ্ধাকে সম্মানের সাথে দাফন করতে হবে। আরো শিখানো হয় যদি যোদ্ধের ময়দারে আমরা শত্রæর কবলে পরি, তখন সেই কবল থেকে যদি বেড়িয়ে আসার সব কৌশল ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে নিজে নিজেকে শেষ করে দেওয়া। তবুও পাক হানাদার বাহিনীর কাছে ধরা না দেওয়া । তখন থেকেই আমি আমার নিজের জন্য সব সময় দু’টি বুলেট আলাদা করে রাখতাম।
ট্রেনিং শেষে শিলং আসি। তখন একটি এলএমজি আমাকে দেওয়া হয়। এলএমজি নিয়ে বালাট সেক্টরে আসি। সেখানে ৫ দিন থাকি। তখনই খবর পাই এক আত্মীয় আমার বিরুদ্ধে রাজাকারদের বলে দেয়। রাজাকাররা আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেই কথা শুনে আমার ভিতর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা যেন আরো বেড়ে গেছে। পর চিনাকান্দি হাবিলদার গণির অধীনে আসলাম। তখন পাঞ্জাবীরা সুনামগঞ্জ শহর দখল করে রেখেছে। আমরা উড়ারকান্দা ব্যাংকার করি। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল পলাশ, সৈয়দপুর, মুসলিমপুর, ভাদেরটেক, এলাকায়। হঠাৎ একদিন উড়ারাকান্দা ব্যাংকারে দুপুরে খাবার সময় পাঞ্জাবীরা আমাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। আমরাও পাল্টা আক্রমণ চালাই। এক পর্যায়ে আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা পিছু হঠে যাই। আমাদের হেড কোয়ার্টার নারায়ণতলা চলে যাই। এই হামলায় ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। পরবর্তীতে পলাশে আমাকে প্লাটুন কমান্ডার করা হয়। একটি স্কুল (পলাশ উচ্চ বিদ্যালয়) ঘরে আমরা থাকি। পাঞ্জাবীরা পলাশে আক্রমণ করে। আমরা স্থানীয় মানুষের দৌড়াদৌড়ির কারণে পাল্টা আক্রমণ করতে পারিনি। অবশেষে আমরা বাধ্য হায়ে পাল্টা হামলা করায় পাঞ্জাবীরা পিছু হঠে। তখন মূলতঃ পাঞ্জাবীর সংখ্যা কম ছিলো রাজাকারের সংখ্যা ছিলো বেশি। হঠাৎ হেডকোয়ার্টের থেকে খবর আসে নারায়ণতলা যাবার জন্য। আমরা সেখনে যাই। তখন গণিকে গ্রেফতার করা হয়। আমি, মুক্তিযোদ্ধ সুধীর দুজন মিলে অপারেশন করি। গোদিরগাঁও গ্রামে এক প্লাটুন নিয়ে এমবুশ করি। তখন স্থানীয় এক দলাল পাঞ্জাবীকে আমাদের অবস্থান কনফার্ম করায় আমরা এমবুশ তুলে পিছনে ফিরে আসি। কিছু দূর থেকে ফায়ার করি। পাঞ্জাবীরা পাল্টা আক্রমণ করে। সেখানে সম্মূখ যুদ্ধ হয়।
মেজর মোতালিব হঠাৎ একদিন আমাদের সবাইকে সুনামগঞ্জ আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। কথা ছিল মেজর মোতালিব বাঁশতলা থেকে আর্টিলারি করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আক্রমণ করবো। আমরা ফরোয়ার্ড হই। কিন্তু তখন আর্টিলারি করায় এবং কোন নির্দেশ না দেওয়ায় আমরা বিপদে পড়ে যাই। ভাগ্যেস আমরা তখন সৈয়দপুর সারারাত থেকে সকাল বেলা সড়ে যাই। দুজন রাজাকার আমাদের দেখে ফেলায় আমরা তাদের উপর গুলি করি সঙ্গে সঙ্গে ঐ রাজাকার দু’জন মারা যায়। পাঞ্জাবীরা তখন আমাদের এ্যাটাক করে। আমরা দ্রæত পিছে ফিরে পাল্টা আক্রমণ করি। এভাবে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলে প্রায় ৮ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস এভাবে যুদ্ধ করি। চিনাকান্দি আমি যখন প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম তখন ইন্ডিয়া থেকে ফোর্স আসে। ঐ সময় গাইন বাড়ি এবং ভাদেরটেকে পাঞ্জাবীদের ব্যাংকার ছিল। আমরা রামপুর স্কুলের পাশের একটি বাড়িতে ছিলাম। পাঞ্জাবীরা আমাদের আক্রমণ করে। আমরা চলতি নদী পাড় হয়ে ধান ক্ষেতে পড়ে পাল্টা আক্রমণ করি। তখনই একটি ছেলে আমাদের কাছ থেকে দৌড় দেওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে গুলি করি আমরা গ্রেনেড চার্জ করি। ব্যাংকার আমরা দখল করি। পাঞ্জাবীরা পিছু হঠে যায়। ৪/৫ জন রাজাকার তখন মারা যায়। আমাদের রসদ কম থাকায় আমরা সেখান থেকে পুনঃরায় হেডকোয়ার্টারে চলে যাই। সেখান থেকে লালার নির্দেশে পাগলা ধরমপুর আসি। সেখান থেকে বসিয়া খাউরি হয়ে বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা হামলা করি। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এডভোকেট রইছ উদ্দিন-এর বাড়িতে আশ্রয় নেই। সেখান থেকে রাজাকার সত্তারের খোঁজ নেই, তাকে পাইনি। পরবর্তীতে আবার নারায়ণতলা আসি। ডিসেম্বর ৬ তারিখ সুনামগঞ্জ শহরে আসি এবং সুনামগঞ্জ মুক্ত করি। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেই। যুদ্ধের চলাকালীন অবস্থায় আমাকে অনেক সময় বিভিন্ন কারণে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। কখনও শাড়ি পরে মহিলা সেঁজে, আবার কখনও পাগলের বেশে। যুদ্ধের সময় গোলা-বারুদের ধুয়ায় আমার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক সময় আমাকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর পুরাতন কোর্টের সামনে সদর থানার এক দারোগা হাছননগরের এক রিকশা চালকে অন্যায় ভাবে মারপিট করলে সেটা দেখে আমি প্রতিবাদ করি। দারোগার সাথে তর্ক-বিতর্ক এক সময় হাতাহাতি পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরে এই দারোগা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা টুকে দেয়। এই মামলাতে আমাকে পালিয়ে থাকতে হয় দীর্ঘদিন। পরে জননেতা আলফাত উদ্দিন মুক্তার এবং মুক্তিযোদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক এডভোকেট আব্দুর রইছ (তৎকালীন এম,পি)। তাঁদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি শেষ করে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
আমার বাবা আরো বলেন, আমি আমার প্লাটুন নিয়ে প্রথম শহরে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা। কোনদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন ধরণের সুবিধা নেওয়ার চিন্তা করিনি। মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য স্বাধীনতার পর এবং অস্ত্র জমা দেওয়ার আগে আমার কাছে থাকা এলএমজি নিয়ে একটা ছবি তুলে রেখেছিলাম। ছবিটা আমার বাংলা ঘরে টানিয়ে রাখতাম। কিন্তু এই ছবিটাই আমার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আমার কাছে অস্ত্র আছে মর্মে কে বা কাহারা রক্ষিবাহিনীকে জানায় এরপর অস্ত্র উদ্ধারের নামে রক্ষিবাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে প্রচন্ড নির্যাতন করে। এই নির্যাতনের ধকল আমি সহ্য করতে পারিনি।
এই ছিল “বাবার মুখে শুনা যোদ্ধের কিছু কথা”। আমার বাবা হৃদরোগে ও দুই দুইবার ব্রেইন স্ট্রোক করে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধের দিনগুলির কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকলেও ঠিক ভাবে বলতে পারতেন না। অবশেষে তিনি ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।  বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আমার বাবা সহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য অবদান চিরজাগ্রত থাকুক। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্বিত। লেখক-সভাপতি,শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ, সুনামগঞ্জ জেলা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn