তাইসির মাহমুদ: সকালে ঘুম থেকে জেগে মোবাইল ফোন হাতে নিতে ভয় হয়। কারণ হোয়াটস-অ্যাপ কিংবা ফেসবুক খুললে যেকোনো একটি দুঃসংবাদ পাওয়া যাবেই। বাসার আশে পাশে কোথাও এসিড অ্যাটাকের ঘটনা ঘটেছে। এসিডে ঝলসে যাওয়া ব্যক্তির ভীবৎস ছবি দেখতে হবে। অথবা শোনা যাবে কোথাও আগুন ধরেছে। এক ব্যক্তি চারতলার উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই। দশ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। অথবা দশজন পথচারির উপর গাড়ির তুলে দিয়ে মারাত্মক যখম করা হয়েছে। হতাহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

কোন শহরের কথা বলছি? কোথায় ঘটছে এসব ঘটনা? নাহ, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে নয়। এসব ঘটছে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর লন্ডনে। যে শহরের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। যে শহরে কেউ কাউকে ফুল দিয়েও ঢিল মারার চেষ্টা করেনা। এই শহরেই ঘটছে এসব ঘটনা।

বর্ণনা শোনে অনেকের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। বিশেষ করে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা লন্ডনে আসতে চান তাদের কাছে এই শহরের বর্তমান হাল শোনে অবাক লাগবে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবে তারচেয়েও অবস্থা আরো খারাপ ।

ঘর থেকে বের হতে ভয় হয়। একা বের হতে তো ভয় হয়ই, স্বপরিবারে বের হলে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কারণ বাইরে যদি কেউ এসিড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলে বের হতেই যদি এসিড ছুড়ে মেরে তাহলে কী হবে? ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে গেলে আপাতত নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু নাহ, গাড়িতে ওঠে উইন্ডো বন্ধ করে ভালোভাবে লক করার আগ পর্যন্ত কিছুতেই নিরাপদ নয়। কারণ খোলা উইন্ডো দিয়ে এসিড ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটছে অহরহ। শুধু এসিড সন্ত্রাসই নয়। ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে আটকেপড়া গাড়ি রড দিয়ে আঘাত করে ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। ভুলবশত গাড়ির উইন্ডো খোলা থাকলে রড দিয়ে আঘাত করে চালক ও যাত্রীর হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। তাই গাড়ির ভেতরেও নিরাপত্তা নেই। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটার সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়। কে, কোন দিকে আসবে? উপরে গাড়ি তুলে দিবে। দূর থেকে ছুড়ে দিবে এসিড।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, লন্ডনে ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে পাঁচটি এসিড অ্যাটাকের ঘটনা ঘটেছে। তাও অধিকাংশই বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়। নর্থ লন্ডনে গ্রেনফিল টাওয়ার ট্রাজেডির পর কমপক্ষে ১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে আরো এক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ক্যামডেনে। একটি মার্কেটে আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই কোথাও না কোথাও অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার খবর আছেই।

সম্প্রতি লন্ডন মুসলিম সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো পুলিশের টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কামান্ডার স্যু উইলিয়ামের সাথে। তাঁর কাছে এসিড অ্যাটাক ও অগ্নিদূর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিলাম। প্রশ্নটি শোনে তাঁর মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ লক্ষ্য করলাম। বললেন, এসডি অ্যাটাকের ঘটনাগুলো ঘটছে বিভিন্ন কারণে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। হেইট ক্রাইমের (ঘৃণাজনিত অপরাধ) কারণে এসিড অ্যাটাকের ঘটনা ঘটছে খুব কম। আর অগ্নিকান্ড বৃদ্ধির বিষয়টিও তাঁর কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়নি। বললেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা হামেশাই ঘটে। এখন বেশি মনে হচ্ছে কারণ, গ্রেনফিল টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর মানুষ আতংকে রয়েছে। কোথাও ছোট একটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। সারাক্ষণ মাতামাতি চলছে। তাই মনে হচ্ছে বেশি বেশি আগুনের ঘটনা ঘটছে। আসলে এসব স্বাভাবিক।

পুলিশ কমান্ডারের বক্তব্য শোনে নিজেকে কিছুটা বেআক্কলই মনে হলো। এই লন্ডনে কি একবারেই নতুন এলাম। এক দু’বছর করে তো চৌদ্দ বছর কাটিয়ে দিলাম। এসেছিলাম একা। এখন স্ত্রীসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার। গত চৌদ্দ বছর লন্ডন শহরকে তো কাছে থেকে দেখলাম। পারিবারিক কলহ, ডাকাতি, কি আগে ছিলো না? ছিলো, কিন্তু এভাবে মাত্র ৯০ মিনিটে পাঁচটি এসিড অ্যাটাকের ঘটনা তো কখনো ঘটেনি। সারা বছরে হয়তোবা দু’চারটি ঘটনা ঘটেছে। তাও সব পূর্ব লন্ডনে নয়। কিন্তু এখন পূর্ব লন্ডন তো দূর্ঘটনার অকুস্থলে পরিণত হয়েছে।
পুলিশ কমান্ডার যা বলেছেন তা সরকারি বক্তব্য। তবে বেসরকারী খবরে এই ঘটনাগুলোকে হেইট ক্রাইমই বলা হচ্ছে। মুসলমান হওয়ার কারণে ঘৃণা করে হামলা করাই হেইট ক্রাইম। শরীরের চামড়ার রঙ সাদা না হয়ে কালো বা বাদামী হওয়ার কারণে হামলা চালানোই হেইট ক্রাইম। আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। পুলিশ কমান্ডারও ঢাকতে পারছেন না।

হেইট ক্রাইমের ঘটনাগুলো ঘটছে ইসলাম বিদ্বেষ থেকে। মুসলিম বিদ্বেষী অপরাধ সবসময়ই কিছু না কিছু ছিলো। তবে এগুলো আলোচনায় তেমন ওঠে আসেনি। কিন্তু গত কয় মাস ধরে মাথাছাড়া দিয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে মানচেস্টার ও লন্ডন ব্রীজ হামলার পর মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ আকারে। নর্থ লন্ডনের ফিন্সবারী পার্কে নিহত মকরম আলীর কথা আমাদের সকলেরই জানা। তারাবিহ’র নামাজ শেষ করে পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি তিনি। শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর গাড়িচাপায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে দশজন। ঘটনার পর বেশ কয়েকটি মসজিদে উড়ো চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে মসজিদ পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। মকরম আলী নিহত হওয়ার পর ফিন্সবারী পার্ক মসজিদেও উড়ো চিঠি এসেছে। এতে বলা হয়েছে, গাড়িচাপা দেয়ার ঘটনা একটি সতর্কতা মাত্র। খুব শীঘ্রই মসজিদে রক্ত গঙ্গা ভাসিয়ে দেওয়া হবে। এসব উড়ো চিঠির খবর পুলিশকে জানানোর পরও মসজিদগুলোর নিরাপত্তার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা বলে মিডিয়ায় খবর হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মসজিদগুলোর মুসল্লিরা চরম আতংকে দিনাতিপাত করছেন।

আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ষাট ও সত্তর দশকে যখন বৃটেন আসেন তখন ইসলামোফবিয়া (ইসলাম বিদ্বেষ) ছিলোনা। ছিলো বর্ণবাদ। তাঁরা রাস্তায় একা হাঁটাচলা করতে পারতেন না। দলবেধে চলাফেরা করতে হতো। নতুবা যখন তখন বর্ণবাদীরা অভিবাসী মানুষের উপর হামলে পড়তো। সিলেটের আলতাব আলীকে তো বর্ণবাদীদের হাতে প্রাণ দিতে হলো। এখন শান্তনা এই যে, হোয়াটচ্যাপেলে তাঁর নামে একটি পার্ক আছে। আলতাব আলী পার্ক। এই আলতাব আলীর মতো মানুষের রক্তের বিনিময়েই পূর্ব লন্ডন থেকে বর্ণবাদ বিদায় নিয়েছিলো। আমরা একটি শান্তিপূর্ন আবাস পেয়েছিলাম। কিন্তু আজ নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে বর্ণবাদ। আগে শরীরের চামড়া কালো হওয়ার কারণে বাঙালিরা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হতেন। আর এখন নির্যাতিত হতে হচ্ছে মুসলিম হওয়ার কারণে। পরনের লেবাসের কারণে। মুসলিম হওয়াটা যেন অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন এলে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের চারপাশে মতো গুনগুন করতে দেখি। টিভি ক্যামেরার সামানে চেহারা দেখানোর জন্য তাঁরা ঘুরঘুর করেন। ‘ওয়ান কমিউনিটি’র কথা বলে বাগাড়ম্বর করেন। তাঁরা আজ কোথায়? অগ্নিদূর্ঘটনা, এসিড অ্যাটাক আর গাড়িচাপার পর তো কিছু করতে দেখিনা। এই দুঃসময়ে তাঁদের কি কোনো দায় দায়িত্ব নেই?

তাইসির মাহমুদ : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn