কে বি আনিস

যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোয় গত দুই থেকে তিন বছর ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর বিদ্বেষমূলক হামলা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের আধুনিকমনা দাবি করা রাষ্ট্রগুলোয় এমনিতেও খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গি হামলা। কিন্তু শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে টার্গেট করে হামলার ঘটনা আধুনিকমনাদের মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্রিটেনে বিদ্বেষমূলক হামলার বিষয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তিন বছর আগে থেকেই অর্থাৎ ২০১৫ সালেই ব্রিটেনে মুসলমানদের লক্ষ্য করে হামলা ও অপদস্থ করার ঘটনা ৩২৬ শতাংশ বেড়ে যায়। আর এসব হামলার প্রধান টার্গেট হচ্ছেন মূলত হিজাব কিংবা বোরকা পরা মুসলিম মহিলারা। সমীক্ষাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেল মামা’র প্রধান শহিদ মালিক ২০১৫ সালেই জানিয়েছিলেন, মুসলিমদের উপর যেভাবে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। পুলিশের কাছেও কিন্তু তখন থেকেই উদ্বেগজনক হারে অভিযোগ আসছিল। কিন্তু তৎকালীন ক্যামেরন সরকার জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়েই বেশি ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।

ব্রিটেনের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মুসলমান। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। নিজ দেশের মানুষ তো আছেই, অভিবাসী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যার অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। যুক্তরাজ্যে যখন মুসলিম বিদ্বেষমূলক হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখনই বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, হামলাকারীদের বেশিরভাগই শেতাঙ্গ এবং বয়সে কিশোর কিংবা তরুণ। অর্থাৎ তাদের মধ্যে মুসলমান সম্পর্কে বিরূপ ধারণা গড়ে উঠছে। বিভিন্ন সংস্থার সুপারিশের পরও কিন্তু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

উল্টো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোর নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় জঙ্গি দমনের নামে সহিংসতা জিইয়ে রেখেছে। কখনও কখনও যার আঁচ তাদেরও সহ্য করতে হয়। ফলে ইউরোপে বসবাসরত সাধারণ নাগরিকের কেউ কেউ মনে করছেন মুসলিমরাই বোধহয় তাদের শক্রু। যা শেতাঙ্গ অমুসলিম তরুণ প্রজন্মের ভেতর বিদ্বেষ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। আবার এটাও সত্য অমুসলিম কিছু উগ্রবাদী সংগঠন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটেনসহ ইউরোপের দেশগুলোয় মুসলিম বিদ্বেষ সৃষ্টিতে কাজ করছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রেই ‘এসিটি ফর আমেরিকা’ নামের একটি কট্টর ডানপন্থী সংগঠন ২০টি রাজ্যের কমপক্ষে ৩০টি শহরে মুসলিমবিরোধী বিক্ষোভ করেছে। আগের বছরে জার্মানী ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিমবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, তাতে দেশগুলোয় মুসলমানের সংখ্যা তো কমেইনি বরং উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্রিটেনে মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধির পরও দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি লন্ডনের যিনি মেয়র, তিনিও কিন্তু একজন মুসলিম! নাম সাদিক খান। শুধু মেয়র পদেই নয়, ব্রিটেনের আইনপ্রণেতাদের মধ্যেও মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।ধারাবাহিকভাবে পথে ঘাটে মৌখিক ও শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হওয়ায় মুসলিম কমিউনিটিতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিম লন্ডনের গ্রিনফেল টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে অধিবাসীদের বাঁচাতে সবার আগে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারা কিন্তু মুসলিম ছিলেন।

ভবনের বাসিন্দারাই জানিয়েছেন, সেহরি খেতে ওঠা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যদি তাদের খবর না দিত। এবং উদ্ধারে এগিয়ে না আসত, তবে লাশের মিছিল দেখা দিত। এমনকি অনেক বাসিন্দা এটাও জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের মুহুর্তে পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ শুরু করেন স্থানীয় মসজিদে নামাজের জন্য জড়ো হওয়া মুসলিম তরুণেরা।বিশ্লেষকেরা বলছেন, মুসলমানদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের পথ যারা বেছে নিয়েছেন তারা আসলে না জেনেই ইসলামের প্রচার চালাচ্ছেন। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, বিধর্মীদের তা জানার সুযোগ করে দিচ্ছেন। যারা না জেনে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে নিজেদের জাহির করত, প্রকৃত সত্য জানার পর তারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন। আর সেটিই ইউরোপের দেশগুলোয় মুসলিম বিদ্বেষী সংগঠনগুলোর চিন্তার কারণ।এমন অবস্থায় যারা ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন লন্ডনের মেয়র সাদিক খানসহ বিশিষ্টজনেরা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn