ভুট্টোর ফাঁসি ও জিয়ার রহস্যজনক মৃত্যু
এ ছাড়া সেদিন সাক্ষাৎ করেন আত্মীয় মনোয়ারুল ইসলাম ও মমতাজ। ভুট্টো জেল সুপারকে বললেন, ‘আমার দাঁতের অবস্থা খারাপ। চিকিৎসক নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দরকার ছিল। পারলে তাকে নিয়ে এসো। ’ ভুট্টো আরও কিছু সময় পর গরম পানি আনতে বললেন জেলখানার কাজকর্মে সহযোগী আবদুর রহমানকে। বললেন, ‘শেভ করব। ’ তিনি নতুন ব্লেড নিলেন শেভের জন্য। মুখে ফেনা তুললেন শেভিং ক্রিম দিয়ে। তারপর শেভ শেষ করলেন নীরবে। কর্নেল রাফিকে বললেন, ‘সকালে স্ত্রী-সন্তান এলো, তোমরা কিছু বললে না। ওদের সঙ্গে আমার শেষ দেখার প্রয়োজন ছিল। তোমরা এ রকম তামাশা না করলেই পারতে। ’ জবাবে রাফি বললেন, ‘স্যার! আমরা আদেশ পালন করছি আর কিছু না। আপনি তো জানেন আমরা কেউ নই। ’ তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর কত ঘণ্টা সময় পাব?’ তারা বললেন, সাত ঘণ্টা। এই প্রথম তাকে একটু বিচলিত মনে হলো। রাত ৮টায় আবদুর রহমানকে বললেন গরম কফি বানিয়ে আনতে। কফি খেতে খেতে তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। তিনি অশ্রু মুছলেন। যার বর্ণনা কর্নেল রাফি বইতে দিয়েছেন। তারপর আবদুর রহমানকে বললেন, ‘জেলজীবনে তুমি অনেক করেছ আমার জন্য। এই সময়ে তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করলে ক্ষমা করে দিও। আজ আমার মৃত্যু হবে। আমি আর কয়েক ঘণ্টার জন্য তোমার অতিথি। ’ ৮টা ৪৫ থেকে ৯টা ৪৫- এক ঘণ্টা উইল লিখলেন। তারপর দাঁত ব্রাশ করলেন কিছুক্ষণ ধরে। মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ালেন। সিগারের পাইপ ও পোড়া কাগজ পরিষ্কার করলেন। নামাজের বিছানা গুছিয়ে রাখলেন টেবিলে। কারারক্ষীকে বললেন, ‘এক ঘণ্টা ঘুমাব। জাগিয়ে দিও। ’
রাত ১২টা বাজার ১ মিনিট আগে তার কক্ষে প্রবেশ করলেন জেল সুপার, চিকিৎসক ও কর্নেল রাফি। ভুট্টো তখন গভীর ঘুমে। তাকে ডাকা হলো। তিনি উঠলেন না। আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। তার নাড়ি ও হার্টবিট পরীক্ষা করলেন চিকিৎসক। বললেন, ‘সব ঠিক আছে। সমস্যা তো দেখছি না। ’ ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪ এপ্রিল। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় চার কারারক্ষী তাকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে। এরপর তিনি জেগে উঠলেন। চারদিকে তাকালেন। তার চেহারায় বিস্ময়! হতাশা। কোথায় তিনি? এ অবস্থায় পরিয়ে দেওয়া হলো কালো মুখোশ। একজন বললেন, ‘আপনি সাহসী মানুষ। স্বাভাবিক থাকুন। ’ রাত ২টা ৪ মিনিটে কার্যকর হলো ফাঁসি। ৩০ মিনিট পর ফাঁসির মঞ্চ থেকে দেহ নামানো হয়। জেল চিকিৎসক আবার পরীক্ষা করলেন। তারপর ঘোষণা দিলেন ‘মৃত’। কারাগারের ভিতরে পিনপতন নীরবতা। মৃতদেহের গোসল শেষে তোলা হয় সেনাবাহিনীর ছোট্ট একটি ট্রাকে। সবকিছু দ্রুত করা হয়। কোথায় যেন তাড়াহুড়া সেনা সদস্যদের। সবকিছু হচ্ছে কঠোর গোপনীয়তায়। সতর্কতায়। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়। সেনাশাসকদের ভয় ছিল বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষ কারাগারে ভেঙে পড়তে পারে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভঙ্গ হতে পারে সামরিক শাসন। জীবিত ভুট্টোর চেয়ে মৃত ভুট্টোকে নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠা! কারাগারে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও জানতেন না ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে। লাশ বহনকারী সেনাগাড়িটি বিমানবন্দরে গিয়ে থামে। ছোট একটি বিমানে লাশ নেওয়া হয় সিন্ধু প্রদেশের লারকানায়। ভুট্টোর পারিবারিক এলাকা। এ অঞ্চলের দাপটশালী জমিদার ছিলেন ভুট্টোর পূর্বপুরুষরা। সেনা-পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তায় দাফন সম্পন্ন হয় গরহি খুদা গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে। এভাবেই শেষ হয় পাকিস্তানের দাপুটে শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর অধ্যায়।
ফাঁসির বিষয়টি কেন এত গোপন রাখা- এ নিয়ে বিবিসি কাজ করে। বিবিসি কথা বলে তখন দায়িত্ব পালনকারী একজন সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাহাত লতিফের সঙ্গে। পরে এ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল হন। সাক্ষাৎকারে ব্রিগেডিয়ার লতিফ বিবিসি রেডিওকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগে মধ্যরাতে এ ফাঁসি কার্যকর হয়। সময়টা গোপন রাখা হয়। এমনকি নিয়ম অনুযায়ী ভুট্টোর পরিবারকেও এ খবর জানানো হয়নি। বেনজির ও তার মা নুসরাত ভুট্টো সকালে সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো তখনো জানতেন না রাতে ফাঁসি দেওয়া হবে। গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় সামরিক সিদ্ধান্ত অনুসারে। বেনজিরের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কারাগারে ভুট্টো অবস্থানকালে রাতে ঘুমাতে পারতেন না। সেনারা তাকে উত্ত্যক্তের চেষ্টা করে; যাতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। প্রতি রাতে তার ঘরের ছাদে উঠে বুটজুতা পরে দাপাদাপি করত। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় এ কাজটি তারা করেছিল কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তারা আশা করে বন্দী মেজাজ গরম করে রক্ষীদের সঙ্গে বাগ্বিতন্ডায় লিপ্ত হবে। বদমেজাজি কোনো সৈন্য তখন গুলি চালাবে। ’ নিয়তি বলে কথা! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যা করেছে তা-ই হলো ভুট্টোর সঙ্গে। ভুট্টো কারাগারে থাকাকালেও ভাবেননি নিষ্ঠুরভাবে ফাঁসি দেওয়া হবে। তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতেন। নিয়মিত সংবাদপত্র পড়তেন। সব সংবাদপত্র দেওয়া হতো। রাত অবধি জেগে বিভিন্ন বই পড়তেন। সকালে ডিম ভাজা রুটি খেয়ে গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দিতেন। তারপর ধরাতেন প্রিয় চুরুট। সেলের বাইরে হাঁটাহাঁটির অনুমতি ছিল কিছু সময়ের জন্য। তিনি হাঁটাহাঁটি করতেন। তার পর আবার নির্জন সেলে ফিরে যেতেন। মামলা চলাকালে তিনি নিজে আদালতে উপস্থিত থাকার আগ্রহ ব্যক্ত করেন একবার। অনুমতি পেলেন। ধোপদুরস্ত কাপড় পরেই আদালতে গেলেন। বিচারকের মুখোমুখি হয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন। উচ্চ আদালতের একজন বিচারক ছিলেন ভুট্টোর সময়ের পররাষ্ট্র সচিব। ভুট্টো তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। নিয়তি বলে কথা! এই বিচারকই ছিলেন ভুট্টোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ। আর যে হত্যাকান্ডের দায়ে ফাঁসি হয় সে মামলাটি ভুট্টোর শাসনকালেই দায়ের। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হয়েছিল। মামলার বাদী প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ আহমেদ রাজা কাসুরি। তার গাড়িতে বারবার হামলা হয়। একটি হামলায় তার বাবা নওয়াব মোহাম্মদ আহমেদ খান নিহত হন। কাসুরি এ হামলার জন্য ভুট্টো ও গোয়েন্দাপ্রধানকে দায়ী করেন। জিয়াউল হকের সামরিক শাসনকালে খারিজ হয়ে যাওয়া পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। মামলার বাকি আসামি ছিলেন সে সময়ের গোয়েন্দাপ্রধান ও সেই বিভাগের পাঁচ সদস্য। তাদের থেকে একজন সাক্ষীও হন। ভুট্টোর বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আসে। বেশির ভাগ ছিল বিরোধী পক্ষকে কঠোরভাবে দমনের।
ভুট্টো ট্র্যাজেডির এ লেখা এখানেই শেষ করলে ভালো হতো। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো জিয়াউল হকের শেষ পরিণতি তুলে আনলে কেমন হয়। চুলের মাঝখানে সিঁিথ করতেন এই জেনারেল। ঠান্ডা মাথায় ঘটাতেন অনেক কিছু। সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন। টানা ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর। মারা যান রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায়। লাশও শনাক্ত করা যায়নি। সময়টা ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট। রাজধানী ইসলামাবাদের ৪০০ মাইল দক্ষিণে ভাওয়ালপুর থেকে ৬০ মাইল দূরে তেমওয়ালিতে মার্কিন আব্রামস ট্যাংকের মহড়া দেখতে যান প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক। সঙ্গে আরও পাঁচ জেনারেল। ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তাও। একই সময়ে তেমওয়ালিতে খুন হওয়া এক আমেরিকান নানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেল ও প্রতিরক্ষা প্রতিনিধি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হার্বাপ ওয়াসসোম। জিয়াউল হক তাদের দুপুরের খাবার খেতে আমন্ত্রণ জানান। খাবার শেষে সবাই আইসক্রিম খান। জিয়াউল হকসহ জেনারেলদের মেজাজ ভালো ছিল না। মহড়ার গোলা ঠিক লক্ষ্যতে আঘাত হানতে পারেনি। ১০ বারই পরীক্ষা হয়েছিল ব্যর্থ। বিষণœ মনে খাওয়া শেষে জিয়াউল হক নামাজ পড়েন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিকে তার সঙ্গে পাকওয়ান প্লেনে ফেরার আমন্ত্রণ জানান। আলাদা প্লেনে ফেরার কথা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের। প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ কূটনীতিকের পক্ষে অবজ্ঞা সৌজন্যে পড়ে না। প্রেসিডেন্টের প্লেন পাকওয়ানে ওঠেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্লেনটি আমেরিকার তৈরি সি-১৩০। ভিআইপি কেবিন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত। ককপিটে ছিলেন পাইলট, কো-পাইলট, নেভিগেটর ও প্রকৌশলী। ভাওয়ালপুর থেকে প্লেনটি যাত্রা করে ৩টা ৪৬ মিনিটে। গন্তব্যস্থল ইসলামাবাদ। কিন্তু ওড়ার পরই প্লেনটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় ভাওয়ালপুর টাওয়ারের সঙ্গে। গ্রামবাসী দেখতে পান বিমানবন্দর থেকে ১৮ মাইল দূরে নদীর ওপর পাকওয়ান ওঠানামা করছে। এডওয়ার্ড জেয় অ্যাপস্টেন লিখেছেন, তৃতীয় গোত্তায় মরুভূমিতে আছড়ে পড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী প্লেনটি। তারপর সোজা মাটির ভিতরে ঢুকে প্রচ- বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। ৩১ যাত্রীর সবাই নিহত হন। তাদের লাশও ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩টা ৫১ মিনিট। এ ব্যাপারে আমেরিকা ও পাকিস্তান অনেক তদন্ত করে। কিন্তু আমেরিকান তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। একজন রাষ্ট্রদূতকে হারিয়েও আমেরিকা ছিল নীরব! পাকিস্তানের তদন্ত কমিটি বলেছিল, খুব সম্ভবত অন্তর্ঘাত! প্লেনে ওঠানো আমের ঝুড়িতে বিস্ফোরক ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। সে বিস্ফোরকেই সুরক্ষিত বিমান বিধ্বস্ত হয়। জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন ভুট্টোকন্যা বেনজির। কিন্তু থাকতে পারেননি বেশিদিন। সে আরেক ইতিহাস! আজ থাকুক সে ইতিহাস। লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।