শুরুতে সাবেক রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট-এর একটি ঘটনা। তিনি একবার এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁকে ক্ষেপাতে এক ব্যক্তি উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘স্যার, আমি একজন ডেমোক্র্যাট।’ রুজভেল্ট জানতে চাইলেন, ‘আপনি ডেমোক্র্যাট কেন, জানতে পারি?’ ঐ ব্যক্তি বললো, ‘আমার দাদা ছিলেন ডেমোক্র্যাট, বাবা ছিলেন ডেমোক্র্যাট, কাজেই আমিও ডেমোক্র্যাট।’ রুজভেল্ট বললেন, ‘এটা কোনো কথা হলো? আপনার দাদা আর বাবা গাধা হলে আপনিও কি গাধা হবেন?’ তখন লোকটি জবাব দিলো, ‘তা হব কেন, আমি তখন হব রিপাবলিকান।’

আমাদের দেশে কিন্তু রাজনীতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বাধীনতার পর থেকে এটাই হচ্ছে। নিজ যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক পরিচয় প্রথা আর তেলবাজিতে দক্ষতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় কিছু লোক এখানে নেতা হয়েছেন, যারা আসলে নেতা না হয়ে অন্য কিছু হলে দেশের জন্য ভালো হতো। সবক্ষেত্রে অবশ্য এক কথা নয়। কেউ কেউ রাজনীতির পাঠ জেনেই জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হতে হয়। রাজনীতি বিজ্ঞানে মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদ বলে স্পষ্টত কিছু না থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে এর সংখ্যা কম নয়। মধ্যবিত্ত বলতে আমি এখানে সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক মানদণ্ডের স্তরবিন্যাসের কোন বিশেষ শ্রেণিকে বোঝাচ্ছি না। যারা রাজনীতির সংজ্ঞা না জেনে, শুধু অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এ স্থানে নিজেকে জাহির করার অপচেষ্টা করে থাকেন; তাদের কথা বলেছি। দেশ গড়তে এরা একটি বাধা, এইসব নেতাদের নটিপনায় সুস্থ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমার ভাবতে অবাক লাগে, আমরা ধরেই নিয়েছি; ক্লাসের পড়া না পারা বখে যাওয়া ছেলেটি রাজনৈতিক দলে নাম লেখাবে। অথচ দেশ গড়তে হলে সবচেয়ে মেধাবীদের এখানে আসতে হবে; কেননা আমার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কাদের পাঠানোর সংস্কৃতি তৈরি করছি এটা ভাবনার বিষয়। আর আমরা দেশের ভালো কিছু আশা করছি, আবার কাজ করছি তার উল্টো, এটা হতে পারে না।

রাজনীতি  হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোন গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর গাছ-গাছালির মধ্যে যে অপ্রয়োজনীয় গাছ বেড়ে উঠে সেটাই আগাছা। গাছের যত্ন নেয়া না হলে একসময় আগাছাই সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। এমনকি প্রয়োজনীয় গাছটিকে প্রায় নিঃশেষও করে দিতে পারে আগাছা।  আমাদের রাজনীতির অঙ্গনেও আগাছা জন্মেছে দীর্ঘ সময় ধরে। আর যারা নিবেদিত প্রাণ তাদের বাদ দিয়ে যদি ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদদের বেশি সুযোগ দেওয়া হয়, তবে একদিন তারা আগাছার মতোই ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো জনতার সমাবেশে বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’। তারপর  যুদ্ধ-বিধ্বস্ত  দেশ পুনর্গঠনে শুরু হলো ব্যাপক আয়োজন।  সেদিন সবই হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে যে আগাছা রয়ে গিয়েছিল এবং নতুন করে জন্ম নিচ্ছিল সেদিকে খেয়াল দেয়ার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কারণ তিনি সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন বাংলা ও বাঙালি জাতির উন্নতির ভাবনায়। কত আগাছা ও পরগাছা জন্ম নিয়েছিলো তা জাতি বুঝতে পেরেছিল ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পরগাছা ও আগাছাগুলোই ডালপালা মেলে এদেশের গণমানুষের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিকে আদর্শহীন ও লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করেছিল। রাজনীতিতে আগাছা তৈরির যে বীজ বপন করা হয়েছিল, তার পরিণতি আজও বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। এদেশের যে রাজনীতি একদিন ছিল সমাজসেবা, আজ তাই হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনীতির নামে আজ দেশসেবা নয়, সন্ত্রাস ও নিজের আখের গুছানোর সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে।

কিছুদিন যাবত দেখছি ব্যাপক হারে বিএনপি নেতা-কর্মীরা বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগে নাম লেখাচ্ছে। বড় অদ্ভুত। দল পরিবর্তন কেউ করতেই পারেন, কিন্তু যে কারণে এরা করছেন তা বিশ্লেষণে গেলে মনখারাপ করা তথ্য বেড়িয়ে আসবে । এ ব্যাপারে একটি কৌতুক বলে নিই। রাজনীতিবিদদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী উইসটন চার্চিলও একাধিকবার দল পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯০৪ সালের দিকে তিনি কনজারভেটিভ পার্টি ত্যাগ করে লিবারেল পার্টিতে যোগ দিয়ে সরকারের মন্ত্রীর পদ দখল করলে তাঁর অনেক গুণমুগ্ধ ভোটার বিপক্ষে চলে যান। বিষয়টা একেবারেই পছন্দ করেন না। সে সময় এক অল্প বয়স্ক বাকপটু মহিলা চার্চিলকে বললেন, ‘মিস্টার চার্চিল, আমি আপনার দুটো জিনিস একেবারেই পছন্দ করি না’। ‘কোন দুটো?’ চার্চিল প্রশ্ন করলেন। ‘আপনার নতুন রাজনীতি ও আপনার গোঁফ’ জবাব দিলেন মহিলা। চার্চিল মুচকি হাসি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ডিয়ার ইয়াং লেডি, ওই দুটোর কোনোটিরই সংস্পর্শে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই আপনার।’

আজকে যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন, তারা কাল যে চলে যাবেন সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। বর্তমানে আমাদের দেশের সরকার দল। আর এ কারণেই সবখানে এতো আওয়ামী লীগার দেখি। অথচ যখন শাপলা চত্বরের ঘটনার পর দেশে জামায়াত-হেফাজত-বিএনপির ইন্ধনে নৈরাজ্য মেতে উঠেছিল,  কোথায় ছিল এত আওয়ামী লীগার? পুলিশ বাহিনী না থাকলে আজকের নব্য লীগারদের টিকিও পেতাম না আমরা। কে না জানে এর বেশিরভাগই গড়ে উঠছে কিছু পাওয়ার আশায়। আজ যদি দল গদিতে না থাকে এদের দেখা মিলবে না।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের প্রিয় কাজ অন্য আরেক নেতার চরিত্রে কালিমা লেপন। আর কলাম লেখকরাও সমালোচনার নাম করে অন্য অনেকের মুখে কালিমা মাখছেন ইচ্ছে মতো। আর এটা করে করে তারা যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন দেশকে সেটা ভাববার সময় হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিহাস থেকে ছোট্ট একটি গল্প। বিখ্যাত কবি ও সমালোচক স্যামুয়েল জনসন খবর পেলেন তাঁর সময়ের একজন নামকরা রাজনৈতিক নারী কলামিস্ট লেখালেখিতে মনোযোগ কিছু কম দিয়ে ইদানীং রূপচর্চায় মেতেছেন। শুনে জনসন মন্তব্য করলেন, ‘অন্যের চরিত্রে কালিমা লেপনের চেয়ে নিজের গালে কালিমা লেপন উত্তম।’

সময়ের হাত ধরে উঠে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসের দায় চুকিয়েছেন। বাংলাদেশের গায়ে চাপিয়ে দেয়া মানবাধিকার, মানবতার কলঙ্ক ঘুচিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে, তাদের শাস্তি দিয়ে তিনি যে  অমর কাহিনী রচনা করে চলেছেন তার কথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে অনুরোধ, একটু ভাববেন; এত এত আওয়ামী শাখা লীগের দরকার কি? এমন কোন লীগ নেই যা গঠিত হয়নি। হকার লীগ, ভিখারি লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আমীর লীগ, ফকির লীগ এত উপশাখার পরও বড় মুশকিল কেউ এদের ঠেকায় না, সেদিন দেখি শিশু লীগও হয়ে গেছে। এত উপদল এত শাখা গঠন করছে কারা? একশ্রেণীর ধান্দাবাজ বিরিয়ানি প্যাকেট আর পানির বোতল দিয়ে কিছু মানুষকে অল্প সময়ের জন্য খুশি রাখতে পারলেও এটাকে রাজনীতি বলে না। এদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
ইংরেজী শব্দ ‘পলিটিক্স’-এর বাংলা রাজনীতি শব্দটির সংস্কার প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের তথাকথিত বাঙালি পণ্ডিতদের করা অনুবাদ রাজনীতির পরিবর্তে এখন জননীতি শব্দটি চালু করলে অনেক বেশি প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি আসা যাবে এবং এর কার্যকারিতা জাতিকে আরও বলিষ্ঠ করবে। নিজের সমাজ ও দেশ গঠনে মনোনিবেশ না  করে যারা শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ করে, তারাই আসলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আগাছা নামের গাছটি হয়ে আজও বর্তমান। সার্বিক অঙ্গনে এইসব  আগাছা-পরগাছাদের সংস্কারের মাধ্যমে যতো বেশি সম্ভব উপড়ে ফেলা যাবে এবং  নির্মূল করার চেষ্টা করা যাবে;  দেশ ততো দ্রুত ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে বলে জনগণ বিশ্বাস করে।

(লেখক – গবেষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কর্মকর্তা)

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn