মাসকাওয়াথ আহসান  — মুক্তচিন্তা শব্দবন্ধটি মানুষ আত্মপরিচয়ের অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। নিজের চিন্তাটিকে একমাত্র সঠিক চিন্তা বলে ধরে না নিয়ে; আরেকজন মানুষের বাস্তবতায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করে তার ভিন্নচিন্তাটিকেও সঠিক চিন্তা বলে উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জনই মুক্তচিন্তার চর্চা। নানা ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ নিজের ধর্মটিকে শ্রেষ্ঠ না ভেবে; অন্যদের ধর্ম বিশ্বাসকে সম্মান জানানোর উদারতাই মুক্তচিন্তা। ধর্ম-বিশ্বাসগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে। সে কারণে নানা-ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কোন অসুবিধা হবারই কথা নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মানুষের বদ্ধ চিন্তা। নিজের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো সঠিক আর অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলো ভুল; এরকম “আত্মশ্রেষ্ঠত্বে” আটকে যাওয়া চিন্তার ভ্রান্তিই চলমান “ধর্মের নামে সহিংসতা’র মূল কারণ। কিন্তু প্রতিটি ধর্মের মূল কথা সত্য-সুন্দর আর মঙ্গল এই মিলের জায়গাটি চিন্তা করলেই এইসব সংঘর্ষ যে মুক্তচিন্তা করার অক্ষমতাজনিত বিভ্রান্তি; তা স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু ধর্মই নয়; রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের বদ্ধ চিন্তার কারণে নানা রাজনৈতিক দলের মাঝে সংঘর্ষ দৃশ্যমান। নিজের রাজনৈতিক আদর্শকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদর্শ বলে ভাবার মানসিক বিভ্রান্তিই এ সংকটের মূল কারণ। ঠিক তেমনি নিজের জাতীয়তাবাদকে শ্রেষ্ঠ ভাবার উন্মাদনা পৃথিবীতে সংঘর্ষ তৈরি করেছে যুগে যুগে। ইতিহাসে তাই “শ্রেষ্ঠত্ব” শব্দটি মানসিক-বিকারের প্রতিশব্দ হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছে।

প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে স্বভাবজনিতভাবেই ইড-ইগো-সুপার ইগো থাকে। এই ইগো বা আত্ম-গর্ব সমাজবদ্ধ সামষ্টিক জীবন যাপনের চেয়ে নিজেকে বিশেষ কেউ হিসেবে তুলে ধরার মানসিক বিকার তৈরি করে। মুক্তচিন্তার ক্ষমতা অর্জন তাই নিজেকে শ্রেষ্ঠ না ভেবে অন্যতম একজন ভাবার সামর্থ্য অর্জন। যে কৃষক ফসল ফলান; যিনি প্রকৃতপক্ষে সমাজের অন্নদাতা; তাকে গৌণ ভাবা আর যিনি তার অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে; অন্যের অন্ন কেড়ে নিয়ে দুর্নীতির ময়ূর প্রাসাদ গড়েছেন তাকে মুখ্য ভাবা সামাজিক অসাম্যের এই দৃষ্টিকটু দৃশ্যপট তৈরি করেছে। শ্রমঘন মানুষদের নিম্নশ্রেণীর বিবেচনা করে; অস্ত্রঘন ও ক্ষমতাঘন মানুষকে উচ্চশ্রেণীতে অধিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়েই জগতব্যাপী মানবতা হননের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। আমাদের চিন্তাকাঠামো এই আবদ্ধ বিশ্বাসে আটকে গেছে যে, মানুষের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। যিনি শ্রমঘন পেশায় রয়েছেন; তার কাজের ফলাফল দৃশ্যমান। কৃষকের শ্রমের ফসল আমাদের খাবার টেবিলে দেখা যায়। একজন পোশাক শ্রমিকের কাজের ফলাফল আমাদের পরিধেয়। কিন্তু বুদ্ধিঘন পেশার লোকের কাজের ফলাফল দৃশ্যমান নয়। এক একটি কাল্পনিক গল্পের বা ধারণার ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ী-ব্যাংকার-বুদ্ধিজীবীর পেশাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সমাজ শ্রমঘন মানুষকে প্রান্তিক আর বুদ্ধিঘন মানুষকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে রেখেছে। এই আবদ্ধ চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে সমান শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের চিন্তা করতে পারাই চিন্তাকে মুক্তি দেয়া।

মুক্তচিন্তার একটা বেশ পোশাকি নাম রয়েছে,’প্রগতিশীলতা’। প্রগতিশীলতা হচ্ছে বদ্ধ চিন্তায় আবদ্ধ না থেকে চিন্তার মাঝে গতি সঞ্চার। গতকাল থেকে আজ কিংবা আজ থেকে আগামিকাল; এরই মাঝে জীবন-চর্যায় অনেক পরিবর্তন ঘটছে। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়াই ‘বুদ্ধি’। আমি যা জানি, যতটুকু দেখেছি, সেটাই পৃথিবী নয়; আমার অভিজ্ঞতার বাইরে বিরাট পৃথিবী রয়েছে। এটা বুঝতে পারা জরুরি। যেমন গ্রামীণ জনপদে বা পাহাড়-অরণ্য-মরুভূমিতে যাদের বসবাস; তাদের নিজস্ব একটি জীবন-ধারা রয়েছে। আবার মেট্রোপলিটনে রয়েছে আরেকটি জীবনধারা। মেট্রোপলিটনের জীবন ধারাকে আধুনিক বলা আর গ্রাম-পাহাড়-অরণ্য-মরুভূমির জীবনকে অনাধুনিক বলাটা স্টেরিওটাইপিং। ফলে আমরা যেটাকে প্রগতিশীলতা বলে উদযাপন করি; তাও ত্রুটিযুক্ত। কেবল রবীন্দ্র-সংগীত শুনলে-বেতফেন শুনে ঘাড় দুলালে-পোশাকে শহুরে কেতা থাকলে-মাতৃভাষার মাঝে দুটি ইংরেজি গুঁজে দিলেই আমি আধুনিক হয়ে গেলাম; আর যে মানুষটি লুঙ্গি পরে পবিত্র গ্রন্থ থেকে তেলাওয়াত করে; অথবা ধুতি পরে কীর্তন গায়; সে অনাধুনিক হয়ে গেছে এরকম ক্লিশে চিন্তাও মুক্তচিন্তার অক্ষমতা। আবার মেট্রোপলিটনের জীবনধারাকে কোন গ্রামীণ জীবন ধারার মানুষ যদি উচ্ছৃঙ্খলতা বলে রায় দেয়; সেটাও ক্লিশে চিন্তা। যার যার জীবন সে যাপন করে; ফলের অন্যের জীবন নিয়ে চিন্তায় নিজের জীবন-যাপন করতে ভুলে যাওয়া নিতান্তই বোকামি। পৃথিবীতে নানা চিন্তার, নানা অভিমতের, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা সংস্কৃতির, নানা পোশাকের, নানা জীবনাচরণের, নানা খাদ্যাভ্যাসের মানুষ রয়েছে বলেই পৃথিবীটা এতো সুন্দর। এ হচ্ছে নানারকম পুষ্পবৈচিত্র্যের বাগানের মতো। সমস্যা হয়ে যায়, যখন গোলাপ ভাবে এ বাগানে কেবল গোলাপই থাকবে; যখন জবা ভাবে এ বাগানে শুধু জবাই থাকবে, টিউলিপ ভাবে এ বাগানে কেবল টিউলিপই থাকবে।

জীববৈচিত্র্যের মাঝেই রয়েছে জগতের প্রাণপ্রবাহ। পাখি-প্রজাপতি-মৌমাছির সাহায্য নিয়ে পরাগায়ন ঘটায় বলেই ফুল ফোটে। তেমনি নানাচিন্তার মানুষের উদ্ভাবন ও শ্রমের সম্মিলনেই সমৃদ্ধ হয় জীবন। চিন্তাবৈচিত্র্যকে উদযাপন করতে শেখার মাঝেই রয়েছে জীবনের সৌন্দর্য অনুধাবনের কৌশল। আর চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনাই কট্টরপন্থা বা উগ্রপন্থা। এই উগ্রপন্থাই বিনাশ ডেকে আনে। একটি মৌলিক চিন্তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরানোর অপচেষ্টাই মৌলবাদ। বিভিন্ন মৌলিক চিন্তার সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া যৌগিক চিন্তাই উদারপন্থা। অন্যের চিন্তাকে সম্মান জানানোর চর্চা পৃথিবীকে যৌথ জীবন যাপনের যোগ্য করে তোলে। সেদিক থেকে ভাবলে মুক্তচিন্তাই সভ্যতার প্রাণশক্তি।-মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

(মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। সুনামগঞ্জ বার্তা অনলাইন  এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে  সুনামগঞ্জ বার্তা অনলাইন আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn