রাজধানীর তুরাগের একটি বাসা থেকে তিন শিশু সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনরা দাবি করছেন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের। নিহত গৃহবধূর স্বামী মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারছেন না। তিনি মনে করেন, সন্তানদের হত্যা করার পর নিজে আত্মহত্যা করতে পারেন তার স্ত্রী। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালের মর্গে মা ও তিন সন্তানের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। এ সময় বাইরে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নিহতদের স্বজনরা। নিহত রেহানা পারভীনের স্বামী মোস্তফা কামাল জানান, বৃহস্পতিবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। ইফতারের পর থেকেই বাইরে ছিলেন তিনি। রাত সোয়া ১২ টার দিকে একটি পাউরুটি হাতে বাসায় ফিরেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করে সাড়া পাচ্ছিলেন না। পরে পেছনের একটা ফুটু দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় স্ত্রী রেহানা পারভীনকে দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেন তিনি। এ সময় বিছানার উপরে তিন সন্তানের নিথর দেহ দেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে যান। খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মোস্তফা কামাল জানান, তার তিন সন্তান পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত মোস্তফা আঁখি (শান্তা), দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী রাইসা মোস্তফা আরিশা (শেফা) ও ১১ মাসের ছেলে সাদ। তাদের গলায় ওড়না প্যাঁচানোর দাগ ছিল। ওড়না পাশেই ছিলো। এরমধ্যে বড় সন্তান রাইসা মোস্তফা শেফার পা ওড়না দিয়ে বাঁধা ছিল।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, তিন সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাদের মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি মেডিকেল পরীক্ষার পরেই বলা যাবে। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

হত্যার কারণ সম্পর্কে মোস্তফা কামাল বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই তারা কামারপাড়ার কালিয়ারটেকের বটতলায় বসবাস করতেন। ভীষণ আর্থিক কষ্টে ছিলেন তিনি। মেয়ে শান্তা ও শেফা কামারপাড়ায় পরশমণি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়তো। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ পর্যন্ত ঠিকমতো দিতে পারতেন না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন স্ত্রী রেহেনা পারভীন। অন্যদিকে, মা ও বোনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিলো না মোস্তফা কামাল ও তার স্ত্রী রেহেনার। আর্থিক সঙ্কট সম্পর্কে মোস্তফা কামাল জানান, একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। পরে ফ্ল্যাটের ব্যবসাও করেছেন। এসব করে টাকা-পয়সা ভালোই ছিলো তার। কিন্তু প্রায় ছয় বছর আগে তুরাগ এলাকার প্রতিবেশী দুই প্রভাবশালী তাকে ফুসলিয়ে ৫০ লাখ টাকা ডেসটিনি নামক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করান। পরে এ টাকার পুরোটাই গচ্চা যায়। এ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন  মোস্তফা কামাল। দুশ্চিন্তায় ছিলেন স্ত্রীও।

অন্যদিকে এই রহস্যময় মৃত্য সম্পর্কে রেহেনা পারভীনের ভাই-বোনেরা দাবি করেছেন তাদের বোন ও বোনের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। নিহত রেহেনা পারভীনের বড় বোন মিরপুরের বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, আমার বোন কোনোভাবেই আত্মহত্যা করতে পারে না। তার ননদ ও ননদের জামাই, শ্বাশুড়ি মিলে তাকে হত্যা করেছে। তিনি জানান, রেহেনাকে ঈদের উপহার হিসেবে কয়েকটা থান কাপড় পাঠিয়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে ফোনে কথা হয়েছিলো রেহেনার সঙ্গে। এ সময় রেহেনা বলেছিলো ঈদে কোনটা বানাবো। তখন রাজিয়া তাকে কালো কাপড়ের জামা বানাতে বলেছিলেন। রাজিয়া বলেন, ঈদ করার ইচ্ছা ছিলো তার। সে কেন আত্মহত্যা করবে। আমার বোন আমাকে বারবার বলতো -চারদিকে আমার শত্রু, আমার ঘুম আসে না। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন রাজিয়া। এ বিষয়ে রেহেনা পারভীনের ভাই মাহবুব আলম শাওন বলেন, তুরাগের কালিয়ারটেকের কামারপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন মোস্তফা কামাল। ২০টি টিনশেড ঘর রয়েছে তাদের। এরমধ্যে তিনটি রুম নিয়ে থাকেন মোস্তফা কামাল এবং পাশের তিনটি রুম নিয়ে থাকেন মোস্তফা কামালের বোন কোহিনূর। বাকি রুমগুলো ভাড়া দেয়া হয়। ভাড়ার টাকা নেন মোস্তফা কামালের মা। শাওন বলেন, আমার বোনের শ্বাশুড়ি-ননদ চাইতো না সে ওই বাসাতে থাকুক। ওরা বাসা থেকে বোন ও ভগ্নিপতিকে বের করে দিতে ষড়যন্ত্র করেছিল। তিনি জানান, গত রোববার ফোনে বোনকে তার বাসা ক্যান্টনমেন্টে বেড়াতে বলেছিলেন। কিন্তু রেহেনা বলেছিল, ওরা ষড়যন্ত্র করছে। এখন বাসা ছাড়া যাবে না। একইভাবে রেহেনার বোন রাজিয়া সুলতানা জানান, তিন বছর ধরে ননদের পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া হতো রেহেনার। ননদের স্বামী মুক্তার আগে সিঙ্গাপুরে ছিল। কয়েক বছর ধরে সে বাড়িতে। কিছুদিন আগেও পানির লাইন নিয়ে ঝগড়া হয় তাদের। এ বিষয়ে তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবে খোদা বলেন, বিষয়টি রহস্যময়। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn