আউয়াল ভাই-
——————————————————————–

শাহরীয়ার বিপ্লব(ফেসবুক থেকে)ঃঃ-

এ রকম এক রুপালী রাত ছিল সেদিন। ৮৭ সালের অক্টোবর এর প্রথম সপ্তাহে। কিছু শীত কিছু উস্নতা। মধ্যনগর থেকে লঞ্চে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা করে ফিরছি সুনামগঞ্জে। আক্তারুজ্জামান সেলিম ভাই, মাসুক ভাই, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজল বরন সিংহ সহ অনেকেই। বিশাল এই লঞ্চযাত্রায় আমাদের সাথে বড় ভাই, অভিভাবক, একই সাথে বন্ধু হিসাবে কখনো আপার ক্লাশে, কখনো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আমাদের সংগ দিয়েছিলেন । লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প চানাচুর আর চায়ের পেয়ালার সাথে হাওরের জ্যোছনার আলোর এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার ঝিলিক ছিলো আব্দুল আউয়াল । প্রিয় আউয়াল ভাই।

সেই থেকে চেনা। জানা। সুনামগঞ্জের ছোট বড় সব কর্মসূচীতে তিনি আসতেন। সিলেট থেকে আসতেন।প্রায় সব কিছুতেই উনার কন্ট্রিবিউশন ছিল। আওয়ামীলীগ এর অনেক নেতাকর্মীকে দেখেছি উনার কাছ থেকে সহযোগীতা নিয়েছেন। কিছু কিছু নেতাকর্মী মাসে মাসে সাহায্য নিতেন অনেকটা বেতনভোগী চাকুরীজীবির মতো। আংগুর মিয়ার হোটেলের প্রায় দিন খাওয়ার বিল একাই দিতেন এই আউয়াল ভাই।

আজো সেই একই রুপালী রাত। মায়াবী জ্যোছনা। হাওরের ঢেঊয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, আফালের ঝাপটার সাথে সমান্তরাল অস্থিরতায় টালমাটাল ছিল যার জীবন। সেই আউয়াল ভাই আজ শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে আছেন কি? নাকি জ্যোছনার আলোআঁধারে জীবনের ছায়া দেখছেন?
অস্পষ্ট ছায়ার মতো ভাংগাগড়ার এক বৈচিত্র্যময় জীবনের ইতি টানলেন নিজে নিজেই।

প্রায় দুই বছর আগে লোকের মুখে শুনেছিলাম উনার গলার অসুস্থতার কথা। নিজে থেকেই দেখতে গেলাম ঢাকার একটি ক্লিনিকে। তখনি ধাক্কা খাই। বললাম কাউকে জানাননি কেন? বললেন কি হবে জানিয়ে? আমি কারো আক্ষেপ শুনতে চাই না। তারপর থেকে যতবার বলেছি, ততবার একই শুনেছি।

এইবার প্রায় দুই মাস যাবৎ নুরজাহানে যমের সাথে রশি টানাটানি করছেন। কিছুদিন আগেও তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার হয়েছিল। পক্ষে বিপক্ষের অনেকে শোক বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলেন। একজন সম্ভাব্য প্রার্থী তো লাশ নেয়ার জন্যে ক্লিনিকে রীতিমত কান্ড বাঁধিয়ে দেন। ভয়ে ডাক্তারগন লাইফসাপোর্ট খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। সেদিন ঢাকা থেকে এসে প্রায় জোর করেই লাইফসাপোর্ট লাগিয়ে রাখলাম। উনার মেয়ে, মেয়ের জামাই আর ভাবীর কান্না বিধাতা কিভাবে শুনেছিলেন বিধাতাই জানেন। আয়ু যেন কিছুদিন বাড়িয়ে দিলেন।

একটা বিশাল জগত ছিল আউয়াল ভাইয়ের। স্পষ্টবাদিতা আর একরোখা স্বভাবের কারনে তাঁর পৃথিবীটা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। তাঁর পক্ষে যারা ছিলেন তাদের তিনি উজার করে দিয়েছিলেন। আর যারা বিরোধী ছিলেন, তিনিও তাদের থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতেন। আঘাতের বিরুদ্ধে পালটা আঘাত। ক্ষমতায় থেকেও তিনি ক্ষমতাহীন। বিরুদ্ধ নদীর মাঝি। যে কারনে উনার বন্ধুরা ইস্কাটনে, ন্যামে, নাখালপাড়ায় যখন সুবিধাভোগে ব্যস্ত, তখন তিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ভাবীকে নিয়ে ইস্কাটনে গিয়েছিলাম সমঝোতার মাধ্যমে যদি তাঁকে বের করা যায়। কিন্তু আউয়াল ভাই ছিলেন একরোখা। নেত্রী ছাড়া উনি কারো কাছেই সাহায্য চাইবেন না।

মরার আগেই আউয়াল ভাইকে কারা যেন মেরে ফেললেন। জানলাম, যাদেরকে তিনি দূরে রাখতেন সেই দুরের লোকেরাই তার লাইফসাপোর্টের দিনগুলিতে আরো সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু করতে না পারুক পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর যাদেরকে সারাজীবন কন্ট্রিবিউশন দিয়ে গেছেন তারা লক্ষ যোজন দূরে থেকে জানাজা পড়ার অপেক্ষা করছেন। অনেকে চোখের দেখাও দেখতে আসেন নি।

আই সি ইউ তে কোমায় আউয়াল ভাই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ। কি আর করার আছে। অনুরোধ করলাম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ভাইকে। ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন সাহেবকে। মিসবাহ ভাই তাৎক্ষনিক ভাবে এলেন। মর্মাহত হলেন। টেলিফোনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে জানালেন। আমাকে বললেন, পিটিশন রেডি করো। পরের দিন মিসবাহ ভাইয়ের সাথে ঢাকায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহায্য করলেন। সি এম এইচে আনার কথা বললেন। আরো সহযোগীতার আশ্বাস দিলেন। ৩০ তারিখে এয়ার এম্বুলেন্সে সিএম এইচে নেয়া হলো। ৩১ তারিখে ব্লাড দেয়া হলো। ভেবেছিলাম হয়তো কিছু উন্নতি হবে। কিন্তু যা হবার তাই হলো। চলেই গেলেন। কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে তিনি নিজের পথেই হাঁটলেন। চির গন্তব্যে।

ঈদের পরের দিন ভাবী জানালেন মৃত্যু সংবাদ। বাড়ী থেকে চলে এলাম সিলেটে। জীবিত আউয়াল ভাইয়ের কাছাকাছি কোনদিন আসতে পারিনি। আর মৃত আউয়াল ভাইয়ের পাশে সারারাত। আমার মতো অনেকেই। মোহিনী দা, প্রবীর বাবু, বাবুল ভাই, হাসান, শামীম। মিসবাহ ভাই বললেন, আমিও যাবো। মধ্যনগর যাবার ব্যবস্থা করো। মাননীয় নেত্রীর নির্দেশ।

মধ্যনগরের বিশাল জানাজায় হাজার হাজার মানুষের ঢল। জাতিধর্ম নির্বিশেষে আক্ষেপ দেখেছি। ছেলের কান্নাজড়িত বক্তব্যের পরে পুরা মাঠে একটা শোকার্ত পরিবেশ তৈরি হলো। আব্দুল আউয়াল কি সত্যিই চলে যাচ্ছেন। এই কফিনে কি তিনিই শুয়ে আছেন? বিশ্বাস হয়েও যে হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মুহিবুর রহমান মানিক এমপি, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি, জেলা আওয়ামীলীগ এর সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন, সাবেক এমপি রফিকুল হক সুহেল, জনাব নাজির হোসেন, ডা, রফিক চৌধুরী, আব্দুল মোতালেব সাহেব, ইউসুফ আল আজাদ, রফিকুল হাসান চৌধুরী, শহিদ ইকবাল, শামিম আহমেদ বিলকিস, কামরুল ইসলাম, বিনয় ভূষন ভানু, রেজাউল করীম শামীম,শামিমা শাহরিয়ার, আনিসুল ইসলাম সহ বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ এসে আউয়াল ভাইকে শেষ বিদায় দিলেন। বিদায়।
আব্দুল আউয়াল। হাওরপুত্র আউয়াল। মধ্যনগরের আউয়াল।।

ফিরে আসছি। হাওরের ছোট ছোট ঢেউয়ে স্পীডবোটে দুলছি আর ভাবছি । আউয়াল ভাই আর কখনো ফিরে আসবে না। কাউকে ভালোবাসবে না, কষ্টও দিবে না। কোন শাসন, না কোন সোহাগ। কোন কিছুতেই মধ্যনগরের মানুষ আর পাবে না। তিনি কি মুক্তি নিলেন? নাকি মুক্তি দিলেন?

একটা বিশাল অধ্যায়ের যবনিকা হলো। আবারো হয়তো আসবো এখানে। কিন্তু মধ্যনগরে আব্দুল আউয়ালকে আর পাওয়া যাবে না।

প্রিয় ভাই, আপনার পাশে দাঁড়াতে পারলাম না। বড় দরকার ছিলো আপনাকে । কোথায় খুঁজবো আপনাকে? জেলেদের নৌকায়, ভাসানপানিতে, বাজারের গলিতে, শহীদমিনারের বেদিতে? নাকি হাওরের আফালে?উজান নদীর নৌকায় নাকি স্বার্থপরতার দমকা হাওয়ায়??

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn