রঙ্গিন দুনিয়া। পার্টি, মদ, গতি। এ দুনিয়ার খবর হয়তো আমাদের অনেকের কাছেই নেই। ডিজে পার্টি, রুম পার্টি। নানা নাম। অন্ধকার এক জগতে ক্রমশ ভেসে যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজেরই একটি অংশ। কতইবা হবে ছেলে বা মেয়েটির বয়স। বাবা হয়তো বিত্তবান ব্যবসায়ী। হয়তো বা কোন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। সন্তানদের সে অর্থে সময় দিতে পারেন না। কিন্তু কাঁড়ি ঢালছেন তাদের পেছনে। অনেকের দিনের পকেট খরচ লাখ টাকা। রঙ্গিন জগতের পেছনে এ অর্থ ব্যয় করছেন তারা।

চাওয়ার যেন শেষ নেই মানুষের। চাই আরো চাই। বাংলাদেশের সমাজে উন্নয়ন বাড়ছে। উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষে মানুষে বৈষম্য। রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে। পরিবার ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়েছে অনেকটাই। যৌথ পরিবার এখন আর নেই। সংখ্যায় স্বল্প হলেও এ দেশেই গড়ে উঠেছে কিছু বৃদ্ধাশ্রম। প্রবীণ বয়সে মা-বাবাদের আশ্রয় হচ্ছে এসব বৃদ্ধাশ্রমে। বয়স্কদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নানা মানসিক সমস্যা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব। ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি কাটাকাটি। স্বামী-স্ত্রী একই খাটে ঘুমান। কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেছে দূরত্ব। ভোগবাদী সমাজে সবাই সীমাহীন ব্যস্ত। বাড়ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন নারী-পুরুষেরা। ভার্চুয়াল জগতের মোহে আটকা পড়ছেন অনেকে। ভার্চুয়াল জগতেই গড়ছেন প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। প্রতারণাও যেন হয়ে গেছে সহজ। প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। নারীরা আসক্ত হচ্ছেন ভারতীয় সিরিয়ালে। আর পশ্চিমাদের অনুকরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন তরুণেরা। অল্পবয়সীরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। গড়ে তুলছে গ্যাং গ্রুপ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, আকাশ সংস্কৃতি, তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার এসবের কারণে সমস্যার একটা বড় অংশ বিভিন্ন দিকে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজ বদলাচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে এবং যুগের চাহিদার কারণে অনেক নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে এবং করছে।  যেটা আগে চিন্তাও করা যেত না। তবে সারা পৃথিবীতেই এসব পার্টি, মদ এই সংস্কৃতি আছে। তবে আমাদের দেশে এসবের কারণে অপরাধটা বেড়ে যাচ্ছে কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে স্বচ্ছতা নেই। আইনের শাসন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজে উৎসাহ দিচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশে এসব সমস্যা আছে। তবে শুধু মাত্রাগত পার্থক্য আছে। শুধুমাত্র ঢাকা নয় সারা দেশেই ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। সময়ের সঙ্গে চিন্তাভাবনা এবং সব ধরনের চাহিদা বাড়ছে। তবে এসব করে যে তারা স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে এটা বলা যাবে না।

যেটাকে আমরা গ্যাং কালচার বলছি এটা আসলে এডভেঞ্চার করার ছলেই কিশোর বা তরুণরা এইসব গড়ে তুলেছে। পাড়ার তিন চারটা সমবয়সী ছেলের কিছুই করার নেই, খেলার মাঠ নেই, তাদের বয়সের নিজেদের শক্তিটা ব্যয় করার জন্য। আর তখনই দেখা যায় কচু গাছ কাটতে কাটতে মানুষ কেটে ফেলছে। বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, সমাজে পরিবর্তনটা খুব দ্রুত এবং হঠাৎ করেই হচ্ছে। শুধু বিভিন্ন ধরনের পার্টি নয়, আরো অনেক কিছুই নতুন করে আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। যেটা আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। কিছু ক্ষেত্রে আমরা শঙ্কায় থাকি এসব পার্টিতে মাদকের ব্যবহার হয় যেটা নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি থাকা উচিত। পরিবার এবং নিজেদের মধ্যে সচেতনতা কমে যাচ্ছে। এসব পার্টিতে কোন বয়সের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে এবং কি করছে এটা নজরদারি রাখা প্রয়োজন। কিশোর বয়সে নিজেদের সমবয়সীদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। তারা জোটবদ্ধ থাকতে চায়। সেখান থেকেই মূলত গ্যাং কালচারটা তৈরি হয়েছে। কারণ এই বাচ্চাগুলো খেলার জায়গা পাচ্ছে না। নিজেদের সমবয়সীদের সঙ্গে মেশার যে প্রবণতা, আকাঙ্ক্ষা সেটা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনবোধ। কিন্তু তারা সে বয়সে একসঙ্গে জোট করে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। যে কারণে গ্যাং কালচারের মতো নতুন একটা সংস্কৃতিতে এসব বাচ্চারা বিপজ্জনক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এই গ্যাং কালচারের কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে পাওয়ার গেম ছাড়া আর কিছু চলে না। এসব বাচ্চা কিশোর বয়সে সঠিক গাইডলাইনটা পরিবার কিংবা সমাজ থেকে পাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, মূলত তিন ধরনের বিষয় নিয়ে মানুষ আমাদের কাছে আসে। প্রথমত, যাদের আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ বা ভারসাম্যহীন বলি। যারা না বুঝেই অনেক কিছু বলেন এবং করেন যেটাতে সহজেই বোঝা যায় তারা সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তবে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ৩% এরও কম। একটা বড় অংশ আসেন যাদের একটা মানসিক সমস্যা হয় তারা নিজে কোনো বিষয় সমাধান করতে পারেন না। তবে তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। যেমন, আমাদের প্রত্যেকের কিন্তু মন খারাপ হয়। এবং মন খারাপ হলে আমরা রিকভারিও করি। কিন্তু এই শ্রেণির মানুষ মন খারাপটা নিজে নিজে সমাধান করতে পারেন না।

আরেকটা বিষয় খুবই জরুরি কিন্তু এটা নিয়ে কেউ আসে না বললেই চলে। সেটা হচ্ছে ইলডারলি প্রবলেম। বয়স্কদের নানারকম মানসিক সমস্যা হয়। যেটা খুবই কম আসে আমাদের কাছে। একটা সময়ে এসে বয়স্করা একলা হয়ে যান। কাজকর্ম যা করতেন আগে এখন তারা আর করতে পারেন না। খুবই কষ্টে থাকেন তারা। তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষ আসলে তেমন একটা ভাবেন না। যেমন একজন মানুষের বয়স সত্তর। তার সন্তানরা সঙ্গে থাকলেও সবাই ব্যস্ত থাকেন। সকালে বের হন আর রাত দশটায় বাসায় ফেরেন যখন সাধারণত ঘুমের সময়। উনি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে থাকলে সন্তানরা কিন্তু বুঝবে না। সিনিয়র সিটিজেন যারা আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়েছেন তাদের আমরা ইগনোর করছি আমাদের চাপের কারনে। আমরা চাই যে এদের নিয়ে মানুষ আসুক।

আমাদের কাছে এই মুহূর্তে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ইমোশনাল এবিউজ। আমাদের দেশে নতুন নিয়ম করা হয়েছে স্কুলে বেতের ব্যবহার করা যাবে না। এখন একটা শিশু হয়তো বাড়ির কাজ ঠিকমতো করছে না কিংবা দুষ্টুমি করে যে কারণে শিক্ষক তাদের একটা দুটা মার দিতেন।  যেটা আপনি খুব সহজেই ভুলে যাবেন। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে শিক্ষকরা কথা দিয়ে শিশুদের মানসিক ভাবে আঘাত করছেন যেটা শিশুরা সহজে ভুলতে পারেন না। আবার ক্লাসের মধ্যে তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, গাধা এসব বলে তাদের দুর্বল করে দেন। অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা ভাবতে শুরু করে যে তাকে দিয়ে আসলেই কিছু হবে না। তখন সে পিছিয়ে পড়ে আর প্রতিদিনই এইভাবে শাস্তি পায়। যেটা বেতের মার থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর। সরকার বেতের ব্যবহার বা মারতে নিষেধ করেছে কিন্তু এর পরিবর্তে শিক্ষকরা কি করবেন সেটা তাদের বলে দেননি। যে কারণে মানসিক সমস্যার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে আমাদের শিশুরা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn