শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো অব্যাহত শিক্ষা ব্যবস্থায় ফের নতুন পদ্ধতি
প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে-কমিয়ে ফল তৈরি হবে * সরকার নির্ধারণ করে দেবে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা * কারিকুলাম-পাঠ্যবই পরিবর্তনের প্রস্তুতিও চলছে * বাতিল করা ‘এসবিএ’ এসেছে ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ নামে *
আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ বানিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত আছে। পাঁচ বছরে কারিকুলাম একবার ও পাঠ্যবই পাঁচবার পরিবর্তন-পরিমার্জন হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতি পাল্টানো হয়েছে কয়েকবার। দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও বদলেছে তিনবার। এমন ভাঙাগড়ার মধ্যেই শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। নতুন এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে-কমিয়ে মূল্যায়ন করা হবে। নম্বরের ভিত্তিতে নয়, সরকার নির্ধারণ করে দেবে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা। এ ছাড়া মাত্র চার বছরের মধ্যে ফের কারিকুলাম এবং এক বছরের মধ্যে পাঠ্যবই পরিবর্তনের প্রস্তুতি চলছে। কারিকুলাম, পাঠ্যবই ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক বসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কারিকুলাম, পাঠ্যবই আর পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিই নয়, শিক্ষার অন্যান্য দিকেও ঘন ঘন কাটাছেঁড়া চলছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে এক শ্রেণীর আমলা ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক বিদেশ ঘুরে আসেন। দেশে ফিরে জাতীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে বিদেশ সফরের লব্ধ জ্ঞানের আলোকে তৈরি নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বিদেশ থেকে ধার করা ওইসব পদ্ধতি অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অসঙ্গতি ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে তা টেনেহিঁচড়ে ছয়-সাত বছর চালু রাখতে দেখা যায়। যদিও নয়া সৃজনশীল পদ্ধতি বহুল সমালোচনার পরও ধরে রাখা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনার মাত্রা বাড়লে একপর্যায়ে তা বাতিল করা হয়। পরিবর্তে ফের চালু হয় নতুন কোনো পদ্ধতি। এভাবে ঘন ঘন এই পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং বেশিরভাগ শিক্ষকই খাপ খাওয়াতে পারেন না। এতে বিপাকে পড়েন শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাই। ফলে খুঁড়িয়ে চলে লেখাপড়া। জোড়াতালির ক্লাস কার্যক্রমের ক্ষতি পোষাতে শিক্ষার্থীকে হতে হয় কোচিং আর প্রাইভেটমুখী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ফলের গুণগত মান নিশ্চিত করা। এটা হলে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে কতটা মেধাবী তা নিরূপিত হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘন ঘন পরিবর্তনের কোনো ঘটনা নেই। ১৯৯৬ সালের পর ২০১২ সালে কারিকুলাম পরিবর্তন হয়েছে। পাঠ্যবইও নতুন হয়েছে দু’বার। পাঠ্যবইয়ে মাঝখানে যা হয়েছে তা শুধু ইতিহাস বিকৃতি দূরের কাজ। সেটা একটা বড় কাজ ছিল। এখন কারিকুলাম ও পাঠ্যবই পর্যালোচনা চলছে। প্রত্যেক দেশেই নির্দিষ্ট সময় পর এটা করা হয়। তিনি স্বীকার করেন, শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছে সৃজনশীল পদ্ধতি। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল, চিন্তাশীল এবং স্বাধীনভাবে লেখার সক্ষমতা তৈরির জন্যই এটি আনা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তা উত্তরণে কাজ চলছে।
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি : গত ২৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ‘স্টান্ডার্ডাইজেশন’ (প্রমিতকরণ) নামে নতুন পদ্ধতির কথা প্রকাশ করেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। গ্রেডিং সিস্টেম বহাল রেখেই শিক্ষার্থীর ফল তৈরি করা হবে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, খাতায় প্রাপ্ত নম্বর সরাসরি শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর থেকে ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের গড় সংখ্যা দিয়ে বিয়োগ করা হবে। এরপর প্রাপ্ত ফল ওই বিষয়ে সব শিক্ষার্থীর নম্বর প্রাপ্তির তারতম্য (স্টান্ডার্ড ডেভিয়েশন) দিয়ে ভাগ করা হবে। এরপর যা আসবে সেটিই শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে। এই পদ্ধতি আনা হলে প্রতিবছর কত শতাংশ শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ দেয়া হবে তা সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হবে।
এ পদ্ধতি প্রবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) পরিচালক রবিউল কবীর চৌধুরী। তিনি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর সরাসরি যোগ করে ফলাফল দিয়ে থাকি। পৃথিবীর কোথাও এটা করা হয় না। এতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত অর্থে মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে আমরা ভালো ছাত্র আর দুর্বল ছাত্রকে চিহ্নিত করতে পারি না। তাই স্টান্ডার্ডাইজেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের চিন্তা করছে সরকার। বর্তমানে আইইএলটিএস, টোফেল, স্যাট, জিআরই এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেবেল পরীক্ষাসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পরীক্ষায় এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্টান্ডার্ডাইজেশন’ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে কয়েকটি দিক বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে, প্রশ্নপত্রের মান বা তা কতটা কঠিন-সহজ ছিল, পরীক্ষকের নম্বর দেয়ার প্রবণতা বা তিনি কম-বেশি নম্বর দিয়েছেন কিনা ইত্যাদি। এ ছাড়া পরীক্ষার হলের পরিবেশ, উত্তর দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীর প্রশ্ন নির্ধারণের ক্ষমতা (সহজ না কঠিন প্রশ্ন বেছে নিয়েছে) বিবেচনায় নেয়া হয়। ক্লাসরুমে পাঠদান (শিক্ষক কতটা সফলভাবে পড়িয়েছেন), জেন্ডার, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বর্তমানে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফল পায়। কিন্তু এটা তার সত্যিকার প্রাপ্ত নম্বর নয়। প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তির চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। কেননা, সেখানে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সঙ্গে অন্য গ্রেডের শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়। এর মানে হচ্ছে, কম জিপিএধারীরা ভালো ছাত্র ছিল। তাই অর্থপূর্ণ নম্বর দিতেই উল্লিখিত পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা আসছে। এটা প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীর র্যাঙ্ক অর্ডারে (যে রেজাল্ট করার কথা) কোনো পরিবর্তন আসবে না। জানা গেছে, আজকের বৈঠকে এ পদ্ধতির পাইলট কার্যক্রম বিষয়ে উপস্থাপনা করা হবে।
সৃজনশীল পদ্ধতি : শিক্ষা পদ্ধতিতে এযাবৎকালের সবচেয়ে ওলটপালট করা পরিবর্তনের নাম ‘সৃজনশীল ব্যবস্থা’। সনাতনী পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের আলোচনা শেষে প্রশ্ন থাকত। শিক্ষার্থীরা পাঠ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে লিখত। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা, কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইড বন্ধ করতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলেও বাস্তবে এর সবই বেড়েছে। সৃজনশীলের চতুর্থ প্রশ্নটি মুখস্থই করে লিখে থাকে শিক্ষর্থীরা। শিক্ষকরা ঠিকমতো না বোঝায় তারাও ক্লাসে ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না। খোদ সরকারি সমীক্ষাই বলছে, ২০০৫ সালে এ পদ্ধতি চালু হলেও ১২ বছরে ৫৬ শতাংশ শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। অপরদিকে শিক্ষকরা যাতে পদ্ধতি বুঝতে পরিশ্রম করেন সে জন্য স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন বাইরে থেকে না কেনার নির্দেশনা ছিল। এ ব্যাপারে পরিপত্রও জারি করা হয়। কিন্তু পদ্ধতি না বোঝায় অনেক শিক্ষক তা মানছেন না। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, খোদ বোর্ড পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীরা আগে এক কোম্পানির গাইড কিনলেও এখন বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ক্লাসরুমের পরিবর্তে চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। শিক্ষকরা এ পদ্ধতি না বোঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করেছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসাও বেড়েছে। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ (ক্যাম্পে) বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে বেডুর পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু শিক্ষকের মানের অভাবে আমরা সৃজনশীল পদ্ধতিটা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সৃজনশীল মানে পাঠ্যবইয়ের গল্পের আদলে শুধু নাম পরিবর্তন করে প্রশ্ন তৈরি নয়; সৃজনশীল পদ্ধতির কথা ছিল- পাঠের মূল স্পিরিট সামনে রেখে প্রশ্ন করা হবে। কিন্তু বোর্ডের প্রশ্নও কেবল নাম পরিবর্তন করে করা হয়।’
কারিকুলাম ও পাঠ্যবই : ২০১০ সালে সরকার শিক্ষানীতি তৈরি করে। এর আলোকে ২০১২ সালে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলাম তৈরি করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছিল। নতুন কারিকুলামের আলোকে ২০১৩ সালে শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হয় পাঠ্যবই। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং চলতি বছরও এসব বই পরিমার্জন-পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর পাঠ্যবই পরিবর্তন নিয়ে সুধী মহলে ব্যাপক আপত্তি উঠেছে। অনেকেরই অভিযোগ- হেফাজতে ইসলামের দাবি আমলে নিয়ে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগে ২০০৯, ২০১০, ২০০৭ ও ২০০২ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়।
এদিকে ২০১২ সালের কারিকুলামের আলোকে স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে কয়েকটি নতুন পাঠ্যবই প্রবর্তন করা হয়। অন্যান্য বিষয়ের মতো এগুলোতেও বার্ষিক, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছিল। নতুন কারিকুলামের অধীনে প্রবর্তিত নতুন বিষয় নিয়ে শোরগোল ওঠে। বিশেষ করে জেএসসি-এসএসসি পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষা নেয়ার প্রশ্নে আপত্তি তোলেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে গত ২২ মার্চ পাবলিক পরীক্ষা থেকে বিষয়গুলো তুলে নেয়া হয়। এখন এগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে স্কুল-মাদ্রাসা পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হবে। আইসিটি বিষয় চালু করলেও এর শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। ফলে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এ শিক্ষা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা বিশ্বেই প্রতি ৫-৭ বছর পরপর কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। ২০১২ সালে যখন আমরা এই কারিকুলাম প্রবর্তন করি, তখনই ২০১৭ সালে এটি পর্যালোচনার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ই কারিকুলাম এবং পাঠ্যবই পর্যালোচনায় দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী জরুরি কিছু থাকলে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করা হবে। তা না থাকলে আমরা বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনা কমিটি করব। মাঠপর্যায় থেকেও মতামত নেয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত কারিকুলাম তৈরি করা হবে। এই দুটি কমিটির সঙ্গে আজ বৈঠকে বসছেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে তাদের কাজের অগ্রগতি আলোচনা করা হবে।’
পরীক্ষা পদ্ধতি : গত দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও অন্তত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে- গ্রেডিং পদ্ধতি, এসবিএ (স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন) ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন। ২০০৭ সালে এসবিএ চালু করতে গেলে এক শ্রেণীর শিক্ষকের দুর্নীতিতে হোঁচট খায়। এ পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষক স্কুলেই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে নম্বর দেবেন। তখন শিক্ষকরা এ পদ্ধতিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে নেন। পরে সমালোচনার মুখে এক বছরেই তা স্থগিত করা হয়। এখন ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে এ পদ্ধতিই আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের মাধ্যমে চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গলার ফাঁস এমসিকিউ : পরীক্ষায় সবচেয়ে বড় মৌলিক পরিবর্তন আসে ১৯৯১ সালে। ওই বছর এসএসসিতে চালু করা হয় ৫০ নম্বরের এমসিকিউ। বাকি ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হতো। এমসিকিউতে প্রতি বিষয়ে ৫০০টি এমসিকিউ প্রশ্ন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তার নাম দেয়া হয় প্রশ্নব্যাংক। সেখান থেকে প্রশ্ন করা হতো। উভয়টি মিলিয়ে তখন ৩৩ নম্বর পেলেই পাস করত পরীক্ষার্থী। ফলে এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী রচনামূলক অংশের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে শুধু ৫০০ এমসিকিউ মুখস্থ করেই পাস করত। এতে পাসের হার রাতারাতি বাড়লেও শিক্ষার মান পড়তে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে প্রশ্নব্যাংক তুলে দিয়ে গোটা বই থেকে এমসিকিউ করা হয়। এতেও শেষরক্ষা হয়নি। এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার হলে বলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। পরে এমসিকিউর পূর্ণ নম্বর কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। কিন্তু জেঁকে বসা দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। ফলে চলতি বছরের এসএসসি থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও দুর্নীতি পিছু ছাড়েনি। চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকায় লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সামনে একটি রেস্তোরাঁ থেকে এমসিকিউ প্রশ্নফাঁস করে সমাধান করার সময়ে দুই শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের ঘটনা আছে।
আরও কিছু পরিবর্তন : ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই চালু করা হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। পরের বছর অষ্টম শ্রেণীতেও একই ধরনের পরীক্ষা জেএসসি চালু করা হয়। শুরু থেকেই এ দুটি পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও আপত্তি ছিল। এর কারণে কোচিং ব্যবসা ব্যাপক বেড়েছে বলে ক্যাম্পের গবেষণায় উঠে আসে। কিন্তু এখনও তা অব্যাহত আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ আছে। সে অনুযায়ী গত বছর মে মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম হস্তান্তর করা হয়। বাস্তবায়ন কার্যক্রম এ পর্যন্তই। অপরদিকে প্রাথমিক স্তর অষ্টমে উন্নীত হলে জেএসসি পরীক্ষার দরকার আছে কিনা- এমন প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই দুটি পরীক্ষার পক্ষে শেষ পর্যন্ত জোরালো অবস্থান দেখা গেছে। অথচ শিক্ষানীতিতে এ দুটি পরীক্ষার কথাই উল্লেখ নেই। অপরদিকে ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ থাকলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি তেমন নেই। ফলে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কারিকুলাম, পাঠ্যবই আর পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিই নয়, শিক্ষার অন্যান্য দিকেও ঘন ঘন কাটাছেঁড়া চলছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে এক শ্রেণীর আমলা ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক বিদেশ ঘুরে আসেন। দেশে ফিরে জাতীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে বিদেশ সফরের লব্ধ জ্ঞানের আলোকে তৈরি নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বিদেশ থেকে ধার করা ওইসব পদ্ধতি অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অসঙ্গতি ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে তা টেনেহিঁচড়ে ছয়-সাত বছর চালু রাখতে দেখা যায়। যদিও নয়া সৃজনশীল পদ্ধতি বহুল সমালোচনার পরও ধরে রাখা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনার মাত্রা বাড়লে একপর্যায়ে তা বাতিল করা হয়। পরিবর্তে ফের চালু হয় নতুন কোনো পদ্ধতি। এভাবে ঘন ঘন এই পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং বেশিরভাগ শিক্ষকই খাপ খাওয়াতে পারেন না। এতে বিপাকে পড়েন শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাই। ফলে খুঁড়িয়ে চলে লেখাপড়া। জোড়াতালির ক্লাস কার্যক্রমের ক্ষতি পোষাতে শিক্ষার্থীকে হতে হয় কোচিং আর প্রাইভেটমুখী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ফলের গুণগত মান নিশ্চিত করা। এটা হলে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে কতটা মেধাবী তা নিরূপিত হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘন ঘন পরিবর্তনের কোনো ঘটনা নেই। ১৯৯৬ সালের পর ২০১২ সালে কারিকুলাম পরিবর্তন হয়েছে। পাঠ্যবইও নতুন হয়েছে দু’বার। পাঠ্যবইয়ে মাঝখানে যা হয়েছে তা শুধু ইতিহাস বিকৃতি দূরের কাজ। সেটা একটা বড় কাজ ছিল। এখন কারিকুলাম ও পাঠ্যবই পর্যালোচনা চলছে। প্রত্যেক দেশেই নির্দিষ্ট সময় পর এটা করা হয়। তিনি স্বীকার করেন, শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছে সৃজনশীল পদ্ধতি। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল, চিন্তাশীল এবং স্বাধীনভাবে লেখার সক্ষমতা তৈরির জন্যই এটি আনা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তা উত্তরণে কাজ চলছে।
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি : গত ২৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ‘স্টান্ডার্ডাইজেশন’ (প্রমিতকরণ) নামে নতুন পদ্ধতির কথা প্রকাশ করেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। গ্রেডিং সিস্টেম বহাল রেখেই শিক্ষার্থীর ফল তৈরি করা হবে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, খাতায় প্রাপ্ত নম্বর সরাসরি শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর থেকে ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের গড় সংখ্যা দিয়ে বিয়োগ করা হবে। এরপর প্রাপ্ত ফল ওই বিষয়ে সব শিক্ষার্থীর নম্বর প্রাপ্তির তারতম্য (স্টান্ডার্ড ডেভিয়েশন) দিয়ে ভাগ করা হবে। এরপর যা আসবে সেটিই শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে। এই পদ্ধতি আনা হলে প্রতিবছর কত শতাংশ শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ দেয়া হবে তা সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হবে।
এ পদ্ধতি প্রবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) পরিচালক রবিউল কবীর চৌধুরী। তিনি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর সরাসরি যোগ করে ফলাফল দিয়ে থাকি। পৃথিবীর কোথাও এটা করা হয় না। এতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত অর্থে মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে আমরা ভালো ছাত্র আর দুর্বল ছাত্রকে চিহ্নিত করতে পারি না। তাই স্টান্ডার্ডাইজেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের চিন্তা করছে সরকার। বর্তমানে আইইএলটিএস, টোফেল, স্যাট, জিআরই এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেবেল পরীক্ষাসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পরীক্ষায় এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্টান্ডার্ডাইজেশন’ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে কয়েকটি দিক বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে, প্রশ্নপত্রের মান বা তা কতটা কঠিন-সহজ ছিল, পরীক্ষকের নম্বর দেয়ার প্রবণতা বা তিনি কম-বেশি নম্বর দিয়েছেন কিনা ইত্যাদি। এ ছাড়া পরীক্ষার হলের পরিবেশ, উত্তর দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীর প্রশ্ন নির্ধারণের ক্ষমতা (সহজ না কঠিন প্রশ্ন বেছে নিয়েছে) বিবেচনায় নেয়া হয়। ক্লাসরুমে পাঠদান (শিক্ষক কতটা সফলভাবে পড়িয়েছেন), জেন্ডার, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বর্তমানে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফল পায়। কিন্তু এটা তার সত্যিকার প্রাপ্ত নম্বর নয়। প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তির চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। কেননা, সেখানে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সঙ্গে অন্য গ্রেডের শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়। এর মানে হচ্ছে, কম জিপিএধারীরা ভালো ছাত্র ছিল। তাই অর্থপূর্ণ নম্বর দিতেই উল্লিখিত পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা আসছে। এটা প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীর র্যাঙ্ক অর্ডারে (যে রেজাল্ট করার কথা) কোনো পরিবর্তন আসবে না। জানা গেছে, আজকের বৈঠকে এ পদ্ধতির পাইলট কার্যক্রম বিষয়ে উপস্থাপনা করা হবে।
সৃজনশীল পদ্ধতি : শিক্ষা পদ্ধতিতে এযাবৎকালের সবচেয়ে ওলটপালট করা পরিবর্তনের নাম ‘সৃজনশীল ব্যবস্থা’। সনাতনী পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের আলোচনা শেষে প্রশ্ন থাকত। শিক্ষার্থীরা পাঠ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে লিখত। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা, কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইড বন্ধ করতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলেও বাস্তবে এর সবই বেড়েছে। সৃজনশীলের চতুর্থ প্রশ্নটি মুখস্থই করে লিখে থাকে শিক্ষর্থীরা। শিক্ষকরা ঠিকমতো না বোঝায় তারাও ক্লাসে ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না। খোদ সরকারি সমীক্ষাই বলছে, ২০০৫ সালে এ পদ্ধতি চালু হলেও ১২ বছরে ৫৬ শতাংশ শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। অপরদিকে শিক্ষকরা যাতে পদ্ধতি বুঝতে পরিশ্রম করেন সে জন্য স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন বাইরে থেকে না কেনার নির্দেশনা ছিল। এ ব্যাপারে পরিপত্রও জারি করা হয়। কিন্তু পদ্ধতি না বোঝায় অনেক শিক্ষক তা মানছেন না। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, খোদ বোর্ড পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীরা আগে এক কোম্পানির গাইড কিনলেও এখন বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ক্লাসরুমের পরিবর্তে চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। শিক্ষকরা এ পদ্ধতি না বোঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করেছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসাও বেড়েছে। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ (ক্যাম্পে) বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে বেডুর পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু শিক্ষকের মানের অভাবে আমরা সৃজনশীল পদ্ধতিটা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সৃজনশীল মানে পাঠ্যবইয়ের গল্পের আদলে শুধু নাম পরিবর্তন করে প্রশ্ন তৈরি নয়; সৃজনশীল পদ্ধতির কথা ছিল- পাঠের মূল স্পিরিট সামনে রেখে প্রশ্ন করা হবে। কিন্তু বোর্ডের প্রশ্নও কেবল নাম পরিবর্তন করে করা হয়।’
কারিকুলাম ও পাঠ্যবই : ২০১০ সালে সরকার শিক্ষানীতি তৈরি করে। এর আলোকে ২০১২ সালে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলাম তৈরি করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছিল। নতুন কারিকুলামের আলোকে ২০১৩ সালে শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হয় পাঠ্যবই। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং চলতি বছরও এসব বই পরিমার্জন-পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর পাঠ্যবই পরিবর্তন নিয়ে সুধী মহলে ব্যাপক আপত্তি উঠেছে। অনেকেরই অভিযোগ- হেফাজতে ইসলামের দাবি আমলে নিয়ে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগে ২০০৯, ২০১০, ২০০৭ ও ২০০২ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়।
এদিকে ২০১২ সালের কারিকুলামের আলোকে স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে কয়েকটি নতুন পাঠ্যবই প্রবর্তন করা হয়। অন্যান্য বিষয়ের মতো এগুলোতেও বার্ষিক, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছিল। নতুন কারিকুলামের অধীনে প্রবর্তিত নতুন বিষয় নিয়ে শোরগোল ওঠে। বিশেষ করে জেএসসি-এসএসসি পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষা নেয়ার প্রশ্নে আপত্তি তোলেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে গত ২২ মার্চ পাবলিক পরীক্ষা থেকে বিষয়গুলো তুলে নেয়া হয়। এখন এগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে স্কুল-মাদ্রাসা পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হবে। আইসিটি বিষয় চালু করলেও এর শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। ফলে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এ শিক্ষা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা বিশ্বেই প্রতি ৫-৭ বছর পরপর কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। ২০১২ সালে যখন আমরা এই কারিকুলাম প্রবর্তন করি, তখনই ২০১৭ সালে এটি পর্যালোচনার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ই কারিকুলাম এবং পাঠ্যবই পর্যালোচনায় দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী জরুরি কিছু থাকলে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করা হবে। তা না থাকলে আমরা বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনা কমিটি করব। মাঠপর্যায় থেকেও মতামত নেয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত কারিকুলাম তৈরি করা হবে। এই দুটি কমিটির সঙ্গে আজ বৈঠকে বসছেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে তাদের কাজের অগ্রগতি আলোচনা করা হবে।’
পরীক্ষা পদ্ধতি : গত দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও অন্তত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে- গ্রেডিং পদ্ধতি, এসবিএ (স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন) ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন। ২০০৭ সালে এসবিএ চালু করতে গেলে এক শ্রেণীর শিক্ষকের দুর্নীতিতে হোঁচট খায়। এ পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষক স্কুলেই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে নম্বর দেবেন। তখন শিক্ষকরা এ পদ্ধতিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে নেন। পরে সমালোচনার মুখে এক বছরেই তা স্থগিত করা হয়। এখন ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে এ পদ্ধতিই আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের মাধ্যমে চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গলার ফাঁস এমসিকিউ : পরীক্ষায় সবচেয়ে বড় মৌলিক পরিবর্তন আসে ১৯৯১ সালে। ওই বছর এসএসসিতে চালু করা হয় ৫০ নম্বরের এমসিকিউ। বাকি ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হতো। এমসিকিউতে প্রতি বিষয়ে ৫০০টি এমসিকিউ প্রশ্ন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তার নাম দেয়া হয় প্রশ্নব্যাংক। সেখান থেকে প্রশ্ন করা হতো। উভয়টি মিলিয়ে তখন ৩৩ নম্বর পেলেই পাস করত পরীক্ষার্থী। ফলে এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী রচনামূলক অংশের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে শুধু ৫০০ এমসিকিউ মুখস্থ করেই পাস করত। এতে পাসের হার রাতারাতি বাড়লেও শিক্ষার মান পড়তে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে প্রশ্নব্যাংক তুলে দিয়ে গোটা বই থেকে এমসিকিউ করা হয়। এতেও শেষরক্ষা হয়নি। এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার হলে বলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। পরে এমসিকিউর পূর্ণ নম্বর কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। কিন্তু জেঁকে বসা দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। ফলে চলতি বছরের এসএসসি থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও দুর্নীতি পিছু ছাড়েনি। চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকায় লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সামনে একটি রেস্তোরাঁ থেকে এমসিকিউ প্রশ্নফাঁস করে সমাধান করার সময়ে দুই শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের ঘটনা আছে।
আরও কিছু পরিবর্তন : ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই চালু করা হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। পরের বছর অষ্টম শ্রেণীতেও একই ধরনের পরীক্ষা জেএসসি চালু করা হয়। শুরু থেকেই এ দুটি পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও আপত্তি ছিল। এর কারণে কোচিং ব্যবসা ব্যাপক বেড়েছে বলে ক্যাম্পের গবেষণায় উঠে আসে। কিন্তু এখনও তা অব্যাহত আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ আছে। সে অনুযায়ী গত বছর মে মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম হস্তান্তর করা হয়। বাস্তবায়ন কার্যক্রম এ পর্যন্তই। অপরদিকে প্রাথমিক স্তর অষ্টমে উন্নীত হলে জেএসসি পরীক্ষার দরকার আছে কিনা- এমন প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই দুটি পরীক্ষার পক্ষে শেষ পর্যন্ত জোরালো অবস্থান দেখা গেছে। অথচ শিক্ষানীতিতে এ দুটি পরীক্ষার কথাই উল্লেখ নেই। অপরদিকে ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ থাকলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি তেমন নেই। ফলে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে।