সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কী ভাবছেন উপাচার্যরা
উপাচার্য পরিষদের প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে-
গত ২৭ এপ্রিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের বৈঠকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত উপ-কমিটির সদস্যরা যোগ দেন। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় সমন্বিত পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে নীতিমালা তৈরির বিষয়ে সদস্যরা মত দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ। সেখানে সদস্যদের সমর্থনে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে তা সরকারের কাছে পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবনা প্রণয়ন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।
তার ভাষ্যমতে, যারা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার, এগ্রিকালচার ও বুয়েটে পড়ে তাদের এসব বিষয়ের উপর পরীক্ষা নেওয়া হয় না। সবার পরীক্ষা নেওয়া হয় মূলত এসএসসি ও এসএইচসির সিলেবাসের উপর ভিত্তি করে। কলেজগুলোতে মূলত তিনটি বিভাগ থাকে। মানবিক, ব্যবসা ও বিজ্ঞান। সারাদেশে এই তিনটি ভাগে ভাগ করে সমন্বিত একশ’ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে এ পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়। দেশে যে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সবকটিতে একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যাবে। যেদিন বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা হবে সেদিন শুধু ওই বিভাগের পরীক্ষা হবে। একইভাবে মানবিকে যেদিন পরীক্ষা হবে সেদিন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগে পরীক্ষা হবে। ব্যবসায় বিভাগেও একইভাবে হবে। এভাবে তিনটি বিভাগে মাত্র তিনটি পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে এই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকদের নিয়ে তিনটি আলাদা কমিটি করে দেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বহুনির্বাচনি পদ্ধতিতে পরীক্ষা না নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর এই পরীক্ষার খাতাগুলো কোডিং করা হবে। তারপর খাতাগুলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে। খাতা মূল্যায়নের পর ফলাফল দেওয়া হবে। এরপর প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হবে। বুয়েটেও তিনটি ধাপে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পরিষদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এই ধরনের একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির নমুনা প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এই পদ্ধতি কো-অর্ডিনেট করলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিলে একটির বেশি পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। যেমন পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পটুয়াখালী থেকে পরীক্ষা দেবে, নোয়াখালী প্রযুক্তির শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে পরীক্ষা দেবে। উপাচার্যদের উপ-কমিটিতে এটা আমি উত্থাপন করেছি, তখন উপাচার্যরা আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসব সভায় যোগ দেয় না।’
সমন্বিত ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে এ প্রস্তাব গত বছর তুলে ধরেছি। কিন্তু তারা বলেছে এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছি তাতে জালিয়াতির আশঙ্কা খুবই কম থাকে। শিক্ষকদের ধারণা, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কষ্ট হবে। পরীক্ষার গুণগত মানও ঠিক রাখা যাবে না। এ পদ্ধতিতে যেহেতু প্রশ্নফাঁসের একটি ঝুঁকি থাকে সেহেতু শিক্ষকদের আগ্রহ খুবই কম থাকে। এবারও আমি শিক্ষকদের কাছে প্রস্তাব তুলবো। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পরিষদ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। তাতে আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার জন্য বলা হয়েছে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয় যদি রাজি হয় তাহলে আমরাও এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে প্রস্তুত। এ বিষয়টি আমি শিক্ষকদের অবহিত করবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমাদের যাচাই-বাছাইয়ের দরকার রয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নেওয়াটাই কষ্টকর। তবে আমরা ভাগ্যবান যে, এখন পর্যন্ত আমাদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়নি। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদিনে পরীক্ষা হওয়া এবং পরীক্ষার প্রশ্ন আনা-নেওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি বড় ধরনের শঙ্কা থেকে যায়। যদি সরকারের পক্ষ থেকে সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং টেকনিক্যালি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে সমন্বিত প্রক্রিয়াটা খারাপ না। কারণ শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে পরীক্ষা দেবে, এতে তাদের ভোগান্তি কমবে। যদি এ প্রক্রিয়াটি কার্যকর করা যায় তাহলে এই পদ্ধতিকে সাধুবাদ জানাই। আমার মনে হয়, এ পদ্ধতিতে কী কী সমস্যা উদ্ভূত হতে পারে তার সার্বিক দিক বিবেচনা করতে পারলে ভালো হবে। এই পদ্ধতি যেহেতু রাষ্ট্রপতিও চেয়েছেন তাই আমরাও চাই। কিন্তু কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যায় তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা আমাদের মতো করে ভর্তি পরীক্ষা নেবো। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও পরীক্ষিত নীতি অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আছে আমরা সেভাবে পরীক্ষা নেবো। একাডেমিক কাউন্সিল দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে পরীক্ষা নিয়ে আসছে, আমরা সে ব্যবস্থাটি রেখে এ বছরও কিছু সংস্কার এনেছি।’ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পরিষদের পক্ষ থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারকে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে- এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে চেষ্টা করছে, সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। সে অনুসারে বিভিন্ন সুপারিশ প্রণীত হলে বিষয়টি আমরা দেখবো।’