সিলেট:: রিজেন্ট গ্রুপ ও হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ‘সিলেটী জামাই’ মো. সাহেদ করিম ওরফে ‘করোনা সাহেদ’র বিরুদ্ধে সিলেট আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। রোববার (৮ নভেম্বর) সিলেট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (১ম) আদালতের বিচারক হারুনুর রশিদ এ রায় প্রদান করেন। সিলেট জৈন্তাপুরের পাথর ব্যবসায়ী, ‘মাওলা স্টোন ক্রাশার মিল’র স্বত্বাধিকারী শামসুল মাওলার দায়ের করা প্রতারণা মামলায় সাহেদের বিরুদ্ধে এ রায় প্রদান করা হয়েছে। চলতি বছরের ৪ মার্চ সিলেট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (১ম) আদালতে সাহেদের বিরুদ্ধে ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকার তিনটি প্রতারণা মামলা দায়ের করেন শামসুল মাওলা। সাহেদের দেয়া ১০ লক্ষ টাকা করে ২ টি চেকে ২০ লক্ষ টাকা ও আরও একটি চেকে ৫০ হাজার টাকা নির্ধারিত সময়ে না পাওয়ায় এ ৩ মামলা করেন তিনি।

করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা বিলম্বের পর আজ রোববার আলোচিত সেই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুনানিকালে বিবাদিপক্ষের আইনজীবি সাহেদের জামিনের আবেদন করলে সিলেট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (১ম) আদালতের বিচারক হারুনুর রশিদ সেটি নাকচ করে সাহেদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তথ্যটি সিলেটভিউ-কে নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এপিপি ও বাদিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আবদুস সাত্তার।  করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ প্রতারণার গুরুতর অভিযোগ উঠার পর গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত এলাকা থেকে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।  এর আগে ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়।

গ্রেফতারের পর ১০ দিনের রিমান্ড শেষে সাহেদকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। সে কারাগারের আলাদা একটি সেলে এককভাবে রাখা হয়েছে তাকে। গ্রেফতারের আগে সিলেটের ব্যবসায়ীদের ঘিরে বিশাল প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলো ‘করোনা সাহেদ’। তার সেই প্রতারণার ফাঁদে ফেঁসে গিয়ে নি:স্ব হয়েছেন সিলেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। এরকমই একজন শামসুল মাওলা।  সিলেটের জাফলং পাথর কোয়ারির একজন মধ্যম সারির ব্যবসায়ী।  শামসুলের  কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার পাথর নিয়ে পুরো টাকাটাই মেরে দিয়েছে প্রতারক সাহেদ। শামসুল জানান, গতবছর হঠাৎ একদিন ঢাকার এক ভদ্রলোক তার কাছ থেকে এক গাড়ি পাথর কেনেন। যাথারীতি নগদে বিলও পরিশোধ করেন সেই ব্যক্তি। যাওয়ার সময় তিনি শামসুল মাওলাকে ঢাকায় গিয়ে তার বসের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন। ‘বস’ (সাহেদ)-এর সাথে দেখা করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য পাথর সরবরাহের বড় একটি কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেবেন বলে শামসুলকে জানান ওই ব্যক্তি। শামসুল মাওলা সরল বিশ্বাসে ঢাকায় গিয়ে শাহেদ নামের কথিত সেই ‘বস’র সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় সাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দেন।

রাজধানীতে সাহেদের আলিশান অফিস, অফিসকক্ষে টানানো রাষ্ট্রের সব ভিআইপিদের সঙ্গে তোলা ছবি দেখে তার কথা বিশ্বাস না করে উপায় ছিলো না  শামসুলের। কথাবার্তার এক পর্যায়ে শামসুল মাওলার সঙ্গে ৩০ লাখ টাকার পাথর সরবরাহের চুক্তি করেন সাহেদ। এরপর আরেকদিন বিল আনতে ঢাকায় গেলে তাকে দশ লাখ টাকা করে ত্রিশ লাখ টাকার তিনটি চেক ধরিয়ে দেয় সাহেদ। খুশিমনে সিলেট ফেরেন শামসুল মাওলা। কিন্তু পরদিন ব্যাংকে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে শামসুলের। ফান্ড স্বল্পতার কারণে দুটি চেক ডিজঅনার হয়। আর অন্য চেকটি তার নিজের একাউন্টেরই নয়, ভুয়া চেক।

বিষয়টি শাহেদকে ফোনে জানাতেই সুর পাল্টে ফেলে সাহেদ। শামসুল মাওলাকে উল্টো গালাগাল করে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। আচমকাই এমন প্রতারণায় দিশেহারা হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন শামসুল।  এরপর টাকার জন্য বহুবার ঢাকায় গিয়ে সাহেদের অফিসে ধর্না দেন,  কিন্তু প্রতিবারই শামসুলকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। একপর্যায়ে ঢাকা উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শাহেদের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন শামসুল মাওলা। জিডির তদন্ত কর্মকর্তা সাহেদকে ফোন দিলে তাকে ‘তুই-তুকারি’ করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়ে নানা হুমকি-ধমকি প্রদান করে সাহেদ। পরে সাহেদ তার অফিসে ডেকে পাঠায় শামসুল মাওলাকে। টাকা পাওয়ার আশায় শামসুল আবারও ছুটে যান সাহেদের অফিসে। কিন্তু সেখানে সাহেদের এক ড্রাইভার তাকে পরামর্শ দেয়- প্রাণে বাঁচতে হলে এখান থেকে চলে যেতে।  ওইদিন সেখান থেকে রীতিমতো পালিয়ে আসেন শামসুল মাওলা।

পরে আবারও ছুটে যান উত্তরা থানায়। পুলিশের কাছে সহায়তা চান। কিন্তু থানার তৎকালীন ওসি তাকে জানান- সাহেদ খুবই প্রভাবশালী লোক। তার বিরুদ্ধে জিডি করে কোনো লাভ হবে না। বরং তাকে সিলেট আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন ওসি। যথারীতি সিলেট ফিরে শামসুল মাওলা আদালতে দুটি চেক ডিজঅনারের মামলা করেন সাহেদের বিরুদ্ধে । দিন, মাস, বছর যায়। কিন্তু মামলায় কোনো প্রতিকার পান না তিনি। উল্টো সাহেদ তাকে প্রায়ই ফোন দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিতেন।  একপর্যায়ে বিশাল অংকের টাকা দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ায় শামসুল মাওলার জীবনে নেমে আসে করুণ বিপর্যয়। পাওনাদাররা তাকে টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকেন। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় শামসুল মাওলার। এমনকি পাওনাদারদের টাকা দিতে না পেরে একসময় বাড়ি ছেড়ে ফেরারি জীবন শুরু করেন তিনি। এদিকে, রিজেন্ট কেলেংকারিতে শাহেদ গ্রেপ্তার হয়েছে খবর পেয়ে র‍্যাব সদর দফতরে গিয়ে হাজির হন শামসুল মাওলা। মামলার কাগজপত্র দেখান র‍্যাব কর্মকর্তাদের। পাওনা টাকা ফিরে পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পরে গত ৪/৩/২০২০ তারিখে সিলেট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (১ম) আদালতে সাহেদের বিরুদ্ধে ২৫ লাখ টাকার তিনটি পৃথক প্রতারণা মামলা দায়ের করেন শামসুল মাওলা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn