মাহবুবুর রহমান ::

‘পরিচয়পত্র পেশের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছি। ভি ভি গিরি ও ফখরুদ্দিন আলী আহমদ। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি। আনুষ্ঠানিকতার একপর্যায়ে ফখরুদ্দিন আলী আহমদ জিজ্ঞেস করলেন, “বাংলাদেশের কোথায় আপনার বাড়ি।” বললাম সিলেটে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি সিলেটের আমিনুর রশীদ চৌধুরীকে চেনেন?”
ফখরুদ্দিন আলী আহমদের প্রশ্নে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। স্বয়ং ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জানতে চাইছেন। বললাম, ‘আমি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই।’ বললেন, ‘তুমি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই!’ রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ভুলে আমাকে জড়িয়ে বললেন, ‘তুমি আমিনের ছোট ভাই। এসো এসো।’
কথাগুলো হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট আমিনুর রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সিলেট প্রেসক্লাবে আয়োজিত শোকসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এভাবেই স্মৃতিচারণা করেছিলেন।
ভি ভি গিরির পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমদ আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে তিনি দিল্লিও সফর করেছেন।
অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন আমিনুর রশীদ চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতে চলে যাওয়ার জন্য আমিনুর রশীদ চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে কোনো এক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত করা হবে। সবিনয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমিনুর রশীদ চৌধুরী বললেন, ‘আমি সিলেট ছেড়ে কোথাও যাব না।’
সিলেটকে আমিনুর রশীদ মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। জীবদ্দশায় তাই সিলেট ছেড়ে কোথাও তিনি যাননি।
আমিনুর রশীদের মালিকানা ও সম্পাদনাকালে বাংলাদেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র যুগভেরীর স্বর্ণযুগ ছিল। যুগভেরীর লাইনে লাইনে থাকত বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার সিলেটের সুখ-দুঃখের কথা। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাই দাবি ছিল, সিলেট অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দানের। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় সিলেটকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার দাবিও উচ্চারিত হয়েছিল যুগভেরীতে।
নিজ অঞ্চলের জন্য নিবেদিত যুগভেরীর এ বিরল সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছিল। আশির দশকে জাতিসংঘের আওতাধীন এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন এশিয়ায় পাঁচটি সংবাদপত্রকে সাফল কমিউনিটি সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুগভেরী তার মধ্যে অন্যতম ছিল।
আমিনুর রশীদ চৌধুরী ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি তাঁর কাছে।
১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য একদিন সিলেট শহরে ব্যাপক গণ্ডগোল করে। সারা শহরের মানুষ ভয়ে তটস্থ। সেদিন আমিনুর রশীদ চৌধুরী ছিলেন ঢাকায়। পরদিন সিলেটে ফেরার পর তাঁর বাসভবন জ্যোতি মঞ্জিলে আসেন সিলেটের রাজনৈতিক নেতরা। যুগভেরীর সম্পাদক সিদ্ধান্ত নেন, এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের ডেকে বললেন, যুগভেরীতে গণপিটুনির খবর যাবে বড় করে। আমি ভয়ে আড়ষ্ট। সাহস দিয়ে বললেন, কোনো ভয় নেই, আমি আছি। আরও বললেন, মনে রাখবেন, সাংবাদিকের এক পা বাড়িতে, আরেক পা কারাগারে। খবর বের হলো যুগভেরীর প্রথম পাতা জুড়ে, ‘সিলেটের ইতিহাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক গণপিটুনি’।
সারা শহরে বিরাট চাঞ্চল্য। পত্রিকা বের করে আমি ভয়ে লুকালাম। দুদিন পর ভয়ে ভয়ে যুগভেরী অফিসে এলাম। এসে শুনলাম, আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে একজন মেজর এসে আমিনুর রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আশ্বাস দিয়ে গেছেন, এ গণপিটুনির প্রতিকার হবে। পরে শুনেছি, সেনাবাহিনীর ওই উচ্ছৃঙ্খল ইউনিটকে প্রত্যাহার করে পদব্রজে কুমিল্লা নেওয়া হয়েছিল।
আমিনুর রশীদ চৌধুরী শুধু নির্ভীক সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন উঁচু মানের সাহিত্যিক। খুব ভালো গদ্য লিখতেন। কলকাতার দেশ সাময়িকীতে তাঁর লেখা বের হতো। মরমি গানও লিখেছেন প্রচুর। তাঁর মানবিক গুণাবলি ছিল অতুলনীয়, ছিলেন দানশীল। ডান হাতে দিলে বাম হাত টের পেত না। রুচিবান, সংস্কৃতিমনা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই আকর্ষণীয়। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপনের জন্য যখন ভয়ে কেউ এগিয়ে আসত না, তখন তাঁর বাসভবনে জাঁকজমকের সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপন করতেন। এ জন্য একাত্তর সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারেরা বন্দিশিবিরে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।
আমিনুর রশীদ চৌধুরীর সব মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর পক্ষ থেকে সমর্থন ও সাহায্য করেছেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী। তিনি সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। এ জন্য তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র যুগভেরীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আশির দশকে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মরহুম আমিনুর রশীদ চৌধুরীর নামে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ আজও হয়নি। এটা আমাকে বিস্মিত করে ও পীড়া দেয়। *লেখক: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn