শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েদের অগ্রগতি ঘটলেও পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারিনি আমরা। এখনো মেয়েদের পরীক্ষায় পাশের পেছনে যতটা শিক্ষিত ও সাবলম্বী হওয়ার উদ্দেশ্য কাজ করে; ঠিক ততটাই কাজ করে পরীক্ষায় পাশ হলে মেয়েটির একটি ভালো বরের সঙ্গে বিয়ে হবে এই চিন্তা। যেভাবেই হোক তাকে পাশ করতে হবে, পেতে হবে ভালো বর।ফেসবুকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন শিক্ষক, লেখক, গবেষক মোহাম্মেদ আমিন।

তিনি লিখেছেন: প্রথম পদায়ন কুড়িগ্রাম। এসএসসি পরীক্ষার ডিউটিতে গেলাম রাজার হাট স্কুলে। নতুন চাকরি, শরীর মনে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতার দাপট। পরীক্ষার হলে ঢুকে বহিষ্কারের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠতাম। এমনভাবে ডিউটি করতাম যেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নয়, বরং বহিষ্কারের জন্য পাঠানো হয়েছে। বহিষ্কারের পর বহিষ্কার করছি। প্রথম দিনই পঁচিশ জনের অধিক ছাত্রছাত্রী বহিষ্কার করি। এভাবে গেল দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দিন। প্রতিদিন আমার হাতে প্রায় সমান সংখ্যক পরীক্ষার্থী বহিষ্কার হয়েছে। নকলের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছাড়াও কয়জন বহিষ্কার করলাম সেই পরিসংখ্যানটি আমাদের মতো নব্য ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সহকর্মীদের সঙ্গে বহিষ্কারের সংখ্যা নিয়ে গল্প করতাম। পঞ্চম দিন অঙ্ক পরীক্ষা। দুই ঘণ্টার মধ্যে ছাব্বিশ জন পরীক্ষার্থী বহিষ্কার হয়ে গেল। পনের মিনিট পর আর একটা মেয়েকে বহিষ্কার করি। বহিষ্কৃত অন্যান্য পরীক্ষার্থীর মতো মেয়েটি কান্নাকাটি করল না। নির্বিকারচিত্তে সোজা আমার হাত ধরে সাবলীল গলায় খুব জোর ঢেলে মোলায়েম কণ্ঠে বলল : স্যার, আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন? আমি মেয়েটির কথা শুনে হতভম্ব। হলের পরীক্ষার্থী আর কর্তব্যরত শিক্ষকগণ আমার অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। মনে হচ্ছিল, সবাই যেন এভাবে আমাকে অপদস্থ করার পরিকল্পনা করেছে।
বললাম : চুপ করো। চুপ করব। তার আগে আমাকে বিয়ে করুন। আমি এবার মুষড়ে পড়লাম লজ্জায়। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রুমে থাকা উচিত নয় মনে করে কক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম। মেয়েটিও আমার পিছনে পিছনে বের হয়ে এল। তার মুখ থেকে অবিরাম বের হয়ে আসছে একই কথা : স্যার, আমাকে বিয়ে করুন, করুন না স্যার। আমি প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকলাম। মেয়েটিও ঢুকে পড়ল। আমি চেয়ারে বসলাম। মেয়েটি আমার পায়ের নিচে বসে পা দুটি দুহাতে চিপে ধরে বলে যাচ্ছিল: স্যার, আমাকে বিয়ে করুন। জীবনে আর কখনো নকল করব না। রুমে প্রধানশিক্ষক ছাড়াও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং পরীক্ষা কমিটির লোকজন আছেন। তাদের দিকে তাকালাম। সবাই মেয়েটির কাণ্ড আর আমার অসহায়ত্ব দেখে হাসছেন। আমি ছাড়া সবাই বহিষ্কারের বিরুদ্ধে।

প্রধান শিক্ষক বললেন : স্যার, মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
: আমি কী করব?
: বহিষ্কার হলে বিয়েটা ভেঙে যাবে। তাই এমন আচরণ করছে। ক্ষমা করা যায় না স্যার?
একজনকে ক্ষমা করলে সবাইকে ক্ষমা করতে হবে। তাই ক্ষমার প্রশ্নই আসে না। প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে মেয়েটির সাহস আরো বেড়ে গেল। সে কণ্ঠকে আগের চেয়ে জোরালো কিন্তু বিগলিত করে বলতে থাকে: স্যার, আমাকে বিয়ে করুন, করুন না স্যার। আপনার মতো স্বামী পেলে জীবনে আর নকল করব না। একবার বিয়ে করে দেখুন স্যার। আপনার পায়ে ধরে বলছি। স্যার আমাকে একটি বার বিয়ে করে দেখুন – – -।

আমার মনে হলো, পুরো ঘটনা পরিকল্পিত। বললাম: এই মেয়ে পা ছাড়ো, উঠে পড়ো।
: স্যার গো, আমাকে বিয়ে করুন, আপনার মতো স্বামী পেলে —-।
মেয়েটির আচরণ সহ্যের সীমা ছড়িয়ে গেল। ওসি সাহেবকে গম্ভীর গলায় বললাম : মেয়েটাকে সরিয়ে নিন। এবার ওসি সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন। একজন মহিলা কন্সটেবল এসে মেয়েটিকে জোর করে নিয়ে গেল। মেয়েটি যেতে যেতেও বলে চলছিল: স্যার, আমাকে বিয়ে করুন। করুন না স্যার , আপনার মতো স্বামী পেলে কোনোদিন নকল করব না, স্যার —।পরীক্ষার হলে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলাম না। রুম থেকে মেয়েটিকে নিয়ে যাবার পর আমি গাড়িতে চড়ে বসলাম। তারপর সোজা কালেক্টরেট। দীর্ঘপথ গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে বার বার কানে এসে নাড়া দিচ্ছিল, মেয়েটির কথা : স্যার,আমাকে বিয়ে করুন, করুন না স্যার – – -। বসকে বললাম: স্যার, আমাকে অন্য স্কুলে ডিউটি দিন। বস বললেন : কেন? উত্তর দেওয়ার আগে আবার কানে এসে বজ্র ঢেলে দিল মেয়েটির গলা : স্যার, আমাকে বিয়ে করুন, করুন না স্যার। আমি জানি না, বহিষ্কৃত মেয়েটির বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল কি না। সেই পঁচিশ বছর আগের কথা। এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে মেয়েটিকে। চোখে ভেসে উঠে অসহায় চোখের চঞ্চল প্রগলভতা। কানে এসে স্পন্দিত হয় মিহি কণ্ঠের আর্তনাদ: স্যার, আমাকে বিয়ে করুন, করুন না স্যার।উৎস:এমটিনিউজ

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn