সঙ্গীতা ইয়াসমিন –

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে অবগত হলাম, প্রিয়মুখ, প্রিয় মানুষ, আমাদের ইমন ভাই, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ, তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার এবারের নতুন শিকার। খাগড়াছড়ি জেলার সদর থানায় তার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করেছেন শফিকুল নামের একজন সেটলার। যার এই ‘সেটলার’ শব্দটিতেও দারুণ আপত্তি; কারণ ব্যারিস্টার সাহেব পার্বত্য জেলায় উস্কানি ছড়াতে আর বাঙালিদেরকে হেয় করতেই নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তিগত পেজে এমন সব কথা লিখেছেন।
সঙ্গত কারণেই ইমতিয়াজ মাহমুদের স্বপক্ষে আমার অবস্থান। যদিও এই ব্যারিস্টার সাহেবকে আমি কোনোদিন চর্ম চক্ষে দেখি নাই, তথাপিও আমি তাঁকে অল্পস্বল্প চিনি। সেই স্বল্প চেনায় এটুকু জানি যে, তিনি দল-মত ও স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিষয়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু সর্বদাই ‘মানুষ’ আর ‘মানুষের অধিকার’! সেই মানুষ পাহাড়ি-বাঙালি, নারী-শিশু, বয়স্ক-যুবক, এবং স্বাভাবিক কিংবা প্রতিবন্ধী। যেখানেই মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, সেখানেই ইমতিয়াজ মাহমুদের কলম সুতীক্ষ্ণ হয়। তিনি ব্যারিস্টার হিসেবে কতটা প্রজ্ঞাবান সে বিষয়ে আমার জানা নেই, তবে তিনি যে একজন প্রাণবন্ত মানুষ সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
কেননা, বর্তমান বাংলাদেশের হানাহানি, রক্তারক্তি, দলবাজি আর নোংরামির মধ্যে বসবাসকারী অসহায় মানুষগুলোর এই নীল দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত, মানুষের শেষ আশ্রয় হয়ে ওঠার মত, মানুষের ভেতরের মরে যাওয়া বোধগুলোকে জাগিয়ে তোলার মত একটা দৃঢ় কিন্তু সুকোমল হৃদয় তিনি তাঁর অন্তরের গহীনে ধারণ করেন। যিনি বিশ্বাস করেন, মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়। যার লেখা পড়ে কেউ যদি উস্কানি পেয়েই থাকেন, তবে সে কেবল হিংস্রতা ভুলে মানুষকে ভালোবাসার উস্কানিই পাবেন সেকথা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি আমি।
বস্তুত, তিনি একজন আইনজ্ঞ; আর যেখানেই আইন লঙ্ঘিত হয়, মানবতা বিপর্যস্ত হয়, সেখানেই তার কী-বোর্ড সচল হয়। আর এই অপরাধের দায়ে যদি তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয় তবে এটাই প্রমাণ হয় নাকি যে, সংবিধানের প্রদেয় আমাদের ‘বাক স্বাধীনতা’ আজ কারারুদ্ধ? এই লেখা লিখতে লিখতেই “দৈনিক আমাদের সময়’র” ২৩ জুলাই, অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদন নজরে এলো, যেখানে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সংশোধন হচ্ছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদটি সত্য হলেও অতিশয় আনন্দিত হয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে খুব সাধুবাদ দিতে পারছিনা এই কারণে যে তাঁরা একই জাতীয় দুটি অপরাধের দুই রকম দণ্ডাদেশ সংশোধন করার লক্ষ্যেই নাকি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখানে গণদাবী কিংবা জনতার বাকস্বাধীনতা রহিতকরণে এই খড়গ ব্যবহারের কোনোরূপ পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

প্রসঙ্গত বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন কী আছে তবে এই অত্যাচারীর খড়গ নামক ‘৫৭ ধারায়’? যা জনগণের স্বাধীন উচ্চারণের কণ্ঠরোধে সদা তৎপর?  তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’  উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যা থেকে আপনারাই বিচার করুন, ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুকের পোস্ট পড়িয়া আপনারা কীরূপে উস্কানি পাইলেন যাহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইল?  আমি নেহায়েত সাধারণ মানুষ।আমার পক্ষে উহা বিচার করা বড়ই দুরূহ।

উল্লেখ্য, এই আইনের শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার। যিনি সত্যানুসন্ধান করতে গিয়েই প্রশাসনের রোষানলে পড়েন এবং তাঁকে নিয়ে পরবর্তী নাটকসমূহ দেশবাসী অতি আনন্দের সাথেই উপভোগ করেছেন। এরপরেও বিখ্যাত-অখ্যাত অনেকেই এই আইনের শিকার হয়েছেন, ভবিষ্যতে আরও অনেকেই হবেন বলেও আশঙ্কা করা যায়।  এহেন পরিস্থিতিতে দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমার দাবী, অবিলম্বে এই কালাকানুন বাতিল করে সংবিধানকে দায়মুক্ত করুন, অতি সত্ত্বর ইমতিয়াজ মাহমুদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে দিন। আর এই দাবী এখন সম্মিলিত জনতার। নইলে জনতার জমে থাকা বিস্ফোরিত ক্ষোভ সামাল দিতে ‘স্বার্থের মিনারে চড়ে বসা ভণ্ডদের’ আর পাশে পাবেন না!

ভুলে যাবেন না, শেষ বিচারে জনতাই আপনাদেরও শেষ ভরসা!   পরিশেষে বলি, যে রাষ্ট্র মানুষের বাকস্বাধীনতাকে আইনের যাঁতাকলে পিষে মারে, সত্যকথনের সাহসকে উৎসাহিত না করে টুটি চেপে হত্যা করে সেই রাষ্ট্রের ন্যায়ের দণ্ড বিকল! সেই রাষ্ট্রের প্রশাসন নপুংসক!  বিকল এই রাষ্ট্রযন্ত্রের অরাজকতার হাত থেকে মানবতার মুক্তি ঘটুক অচিরেই! গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এই অপাপবিদ্ধ ভণ্ডামি থেকে মুক্তি পাক আমাদের আইন প্রণেতারা! মানবাধিকার আর সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে বালখিল্য এই নাটকের যবনিকাপাত হোক এখনই!  ভালো থাকুন ইমতিয়াজ ভাই, ভালো থাকুক প্রিয় স্বদেশ!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn