কেয়া চৌধুরী |

‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ এক নামে-এক স্লোগানে বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগের ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ সেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সংগ্রাম আন্দোলন ও মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যমে এই রাজনৈতিক দল এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রচীনতম রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে, দীর্ঘপথ চলা এই দলটি মানুষকে পথ দেখিয়েছে মুক্তির। যে মুক্তি স্বাধীনতার, যে মুক্তি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের পর থেকেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে, জমিদার খান বাহাদুরদের গণ্ডি ছাড়িয়ে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের-গণমানুষের দলে পরিণত হতে থাকে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ছোবল থেকে প্রগ্রতিবাদে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় জনগণের প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ‘জনগণের লীগে’ পরিণত হয়। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ধাপে-ধাপে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে থাকেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। আওয়ামী লীগ জনগণকে উজ্জীবিত করেছে। বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে, এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৬৬ সালে। ৬ দফা ছিল সেই মুক্তির সনদ, সংগ্রামের পথ বেয়ে যা একদফায় পরিণত হয়েছিল। সেই এক দফা বাংলার স্বাধীনতা। এর জন্য আওয়ামী লীগকে ২৩ বছর  আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতৃবৃন্দ নানা নির্যাতনের মধ্যে থেকেও জনগণের কাছে বঙ্গবঙ্গুর মুক্তির সনদ ৬ দফা পৌঁছে দিয়েছেন।
৬ দফার প্রশ্নে আপসহীন বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন, বাংলার ৭ কোটি জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে। যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসম। বাঙালির বীরত্ব বিশ্বে নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগ জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে পেরেছিল বলে, নিজের জীবন পরিবার-পরিজন রেখে; শুধু স্বাধীনতার প্রশ্নে ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিলো অকাতরে। আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম মহান স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতাকে মহিমান্বিত করতে আওয়ামী লীগই বাঙালি জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন নেতা শেখ মুজিব ফাঁসির মঞ্চকে বেছে নিলেও পাকিস্তান সরকার ও জুলফিকার আলী ভুট্টু বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ১০ মাস কারাবাস শেষে, জীবন-মৃত্যুর সন্দিক্ষণে থাকা শেখ মুজিব সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার স্বপ্ন নিয়ে, ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই যুক্তরাজ্যের ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে পৃথিবীর সকল দেশের কাছে দাবি জানান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিকরণে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা মুজিব সেদিনই বুঝতে পেরেছিলেন, অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে আইনগতভাবে টিকিয়ে রাখতে অপরাপর দেশ এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রয়োজন এবং তা যত দ্রুত সম্ভব। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে, বাংলাদেশকে শুধু স্বাধীনতার গৌরবে, সম্মানিত করেনি আওয়ামী লীগ। আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে নিরন্তর কর্মযজ্ঞ চালিয়েছে আসছে আওয়ামী লীগ। অর্থনৈতিক নানা পরিসংখ্যানে বিশ্বমোড়লদের মুখে যখন সদ্য স্বাদীন বাংলাদেশ আদৌ টিকে থাকবে কিনা এমন প্রশ্ন। তার সঙ্গে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি পরগাছাদের স্বদেশের মাটিতে বসে, অন্ধকার নীলনকশার ষড়যন্ত্রের মধ্য থেকেও বঙ্গবন্ধু জীবন বাজি রেখে স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন, যার নাম “সোনার বাংলা”। একদিকে চরম দারিদ্র্যপূর্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, তার সঙ্গে ১৯৬৮ সালের বন্যা, ১৯৬৭ ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ২ লক্ষ প্রাণহানি, কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি,  ভারত থেকে ফেরা ১ কোটি শরণার্থী, পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দলাল’দের হাতে ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ সম্ভ্রমহারা নারীর পুনর্বাসন। একদিকে প্রশাসন সুষমকরণ, মুক্তিযোদ্ধা-নির্যাতিতা নারী, শরণার্থী, ধ্বংসপ্রাপ্তদের পুনর্বাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন তথা অবকাঠামোর উন্নয়ন- এসবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পোড়া মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশাল স্বপ্ন বাস্তবায়নে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। এত প্রতিকূল পরিবেশে পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের জন্য, জনগণের তরে নিবেদিত হয়ে, একটি জাতিকে নির্মাণ পূর্বের ইতিহাস গড়তে পারনি, যা আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে করতে পেরেছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যখনি বাংলার মানুষের বিশাল স্বপ্ন পূরণে সাফল্যের দোরগোড়ায় এসেছে, তখনই এসেছে অন্ধকার হায়েনার কালো থাবা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে ম্লান করতে যে দুষ্টচক্রের সহযোগিতায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেই একই ক্ষমতালোভী দেশবিরোধীচক্র স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ধানমন্ডির ৩২ বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোররাতে।
বঙ্গবন্ধুর স্ব-স্বীকৃত খুনি কর্নেল রশিদসহ খুনিরা যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুরস্কৃত হয়ে যখন দেশ-বিদেশে ভালো অবস্থানে চাকরি করে, তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেপ্তার করে অন্ধকার কারাগারে বিনা বিচারে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী যাতে উঠে আসতে না পারে, নিষিদ্ধ হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  নাম আর একাত্তরের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’।
আওয়ামী লীগকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নের সারথী হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করলে; বঙ্গবন্ধুর অজন্ম স্বপ্ন আত্মমর্যাদাশীল সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রেও বিশ্বাসী বলেই বিএনপির সংবিধান স্থগিতের মাধ্যমে মার্শাল ‘ল-র বিপরীতে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে আবারো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ‘জবাবদিহি’ ও ‘দায়বদ্ধতা’ নিশ্চিত হয়।
১/১১-তে আওয়ামী লীগকে মামলা দিয়ে দেশত্যাগের ভয় দেখিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল অবৈধ শক্তি। ১১ মাস অন্যায়ভাবে বিশেষ কারাগারে বন্দি রেখে হত্যার চেষ্টা হয়েছে নীরবে। ‘কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে’। বাংলার ইতিহাসের কাঙ্ক্ষিত অধ্যায়; বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ বাংলার মাটিতে হবে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যার ঐতিহাসিক দায়িত্ব। সেখান থেকে আবার বাংলাদেশকে মূলধারায় নিয়ে আসবার দায়িত্ব পালন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ‘৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু খুনিদের বিচার, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনগণের পূর্ণ সহযোগিতায় করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ; আজ বিশ্ব ফোরামে দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক মুক্তির রোল মডেল।  ২০০৯ সাল থেকে জনগণের সমর্থনে দুই মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগ সরকার ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বের কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে জাতীয় ও বিশ্ব অঙ্গনে। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ৫২’র রাষ্ট্রভাষা, আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের প্রতীক ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে ইউনেসকো স্বীকৃতি পেয়েছে।  বিশ্বমন্দার মধ্যেও ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা আওয়ামী লীগ সরকার এখন ৭, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। জঙ্গি সন্ত্রাসের মদতদাতা বিএনপি কানাডা ফেডারেল কোর্টের রায়ে যখন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত, ঠিক একই সময়ে জাতিসংঘের বিশ্ব ফোরামে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা শুধু জঙ্গিবাদকে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেননি, বরং ২০১৬-এর ১লা জুলাই ‘হলি আর্টিজান’ হামলা, যা আজ বৈশ্বিক সমস্যা; সেই জঙ্গিবাদ নির্মূলে সফল এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন। চরম দরিদ্রতা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, স্কুলে ঝরে পড়া  হ্রাসসহ নারীর ক্ষমতায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরে-বাংলাদেশ ও  আওয়ামী লীগ সরকার আজ বিশ্ব ফোরামে নজিরবিহীন সাফল্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভূয়সী প্রশংসা নিয়ে আলোচনা হয় (তথ্য: সমকাল ১৪ই মে, ২০১৭ইং)।

লেখক: সংসদ সদস্য

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn