আক্তার আহমদ শাহেদ-

লন্ডনে মসজিদের কাছে মুসল্লিদের ওপর ভ্যান হামলায় নিহত বাংলাদেশি মকরম আলী ইরনের (৬২) গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথের সরুয়ালায় চলছে শোকের মাতম। প্রিয়জন হারানো পরিবার-পরিজনের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
গতকাল ইরনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ভেতর থেকে কয়েকজন মহিলার কান্নার আওয়াজ। ইরনের বড় ভাইয়ের ছেলে জিয়াদ আহমদ জানালেন, ভেতরে নিহত ইরনের দুই বোন কান্নাকাটি করছেন। কথা বলতে গিয়ে তিনিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ইরনের দু’বোন সিতারা বেগম ও তেরাবান বিবি জানান, আমরা তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। আমাদের বড় দুই ভাই অনেক আগেই মারা গেছেন। যার কারণে, ভাই বলতে ইরনই ছিল সকলের আদরের। সোমবারের হামলায় তার নিহত হওয়ার খবর শুনে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বার বছর আগে বিশ্বনাথ উপজেলার সরুয়ালা গ্রামের মৃত আবদুল গণির পুত্র মকরম আলী ইরন লন্ডনে পাড়ি জমান। দুই ছেলে ও চার কন্যাসন্তানের জনক ইরন দীর্ঘদিন ধরে স্বপরিবারে সেখানেই বসবাস করে আসছিলেন। গ্রামে তার বড় দুই ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবারের বসবাস। ২০১৫ সালের আগস্টে তিনি সর্বশেষ দেশে আসেন এবং এই রমজানের পূর্বে বাড়ির স্বজনের সঙ্গে ফোনে সর্বশেষ কথা হয় তার।
সোমবার লন্ডনের স্থানীয় সময় রাত ১২টার দিকে সেভেন সিস্টারস রোডের মুসলিম ওয়েলফেয়ার মসজিদের মুসল্লিদের ওপর ভ্যান হামলা চালানো হয়। তারাবি নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন মুসল্লিরা। এ সময় ভ্যানচাপায় বিশ্বনাথের মকরম আলী ইরন নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হন। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক চালককে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ফিন্সবুরিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
লন্ডনের ফিন্সবুরি পার্ক মসজিদের বাইরে মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতদের প্রতি সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য দেখিয়ে পুষ্প অর্পণ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রোববার দিবাগত রাতে ওই মসজিদে তারাবি নামাজ আদায় করার পর একদল মুসল্লির ওপর বিশাল আকারের একটি সাদা ভ্যান উঠিয়ে দেয় ড্যারেন অসবর্ন (৪৭) নামে এক সন্ত্রাসী। সে তিন সন্তানের জনক। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লন্ডন পুলিশ এ হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যায়িত করেছে। হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশি মাকরাম আলী (৫২)। বাংলাদেশে তার বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথে। লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলেছে, ঘটনার পর সোমবার রাতে কয়েক শত মানুষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নিহত মাকরাম আলীর প্রতি ও আহতদের উদ্দেশ্যে। পবিত্র রমজান মাসের শেষের দিকে ফিন্সবুরি পার্ক এলাকায় ইফতারের পর মুসলিমদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়টিকেই হামলার জন্য বেছে নেয় সন্ত্রাসী ড্যারেন অসবর্ন। তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, মুসল্লিদের ওপর ভ্যান উঠিয়ে দেয়ার কারণে একজন নিহত হন। আহত হন ৮ থেকে ১০ জন। এরপরই ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায় দু’জন। কিন্তু পালাতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে ড্যারেন অসবর্ন। এ সময় স্থানীয় মসজিদের ইমাম তাকে প্রহার না করতে জনগণকে অনুরোধ করেন। তখন ড্যারেন অসবর্ন চিৎকার করে বলতে থাকে- আমি সব মুসলিমকে হত্যা করতে চাই। এখন তার বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা ও হত্যার উদ্দেশে হামলার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে। তারা তদন্ত করে দেখছে সে সন্ত্রাসের প্রস্তুতি নিয়ে অথবা উৎসাহিত হয়ে এমন কাজ করেছে কিনা। তাকে গ্রেপ্তার করে সরিয়ে নেয়ার পর পরই লোকজন ফুল হাতে ছুটে যায় সেখানে। তাদের কারো হাতে ব্যানারে লেখা ছিল ‘আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ’। আবার কারে কাছে লেখা ছিল ‘#আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি’। একপর্যায়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ক্রেসিডা ডিকের নেতৃত্বে বিভিন্ন ধর্মের নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ফিন্সবুরি পার্ক মসজিদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কোজবার। সবার এমন সাড়াকে মহত উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। ফিন্সবুরি পার্ক হামলাকে তিনি ওয়েস্টমিনস্টার, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজ হামলার মতোই সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেন। মোহাম্মদ কোজবার বলেন, ফিন্সববুরিতে আমরা আমাদের পরিবার, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মর্যাদার ওপর এক ভয়াবহ হামলা অবলোকন করলাম। ৬ সন্তানের পিতা মাকরাম আলীকে হত্যা করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। সন্ত্রাসী এ হামলায় আহত হয়েছেন অনেকে। এসব মানুষ, এসব সন্ত্রাসীর একটিই উদ্দেশ্য- তাহলো তারা আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায়। ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে চায়। ছড়িয়ে দিতে চায় আতঙ্ক। ফিন্সবুরি পার্ক এলাকায় আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করছি। সন্ত্রাসীরা আমাদের সেই সৌহার্দ্যকে বিভক্ত করতে চায়। কিন্তু আমাদের কথা- আমরা এমনটা হতে দেবো না। শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্য ধর্মীয় নেতারাও। উপস্থিত ছিলেন স্টিফনি’র বিশপ রেভারেন্ড আদ্রিয়ান নিউম্যান। তিনি বলেছেন, একটি ধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর হামলা মানে আমাদের সবার ওপর হামলা। রাবি হারশেল গ্লাক বলেন, এই ঘটনা বৃটেনে সব মুসলিমের ওপর হামলা। এতে তারা আহত হয়েছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর একটি একক হামলা মানে হলো গ্রেট বৃটেনের প্রতিটি নাগরিকের ওপর হামলা। কারণ, আমরা সবাই মিলে এক জাতি। আমরা একসঙ্গে বসবাস করি। একসঙ্গে কাজ করি। দেশ গড়তে একে অন্যকে সহযোগিতা করি। ওদিকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বলেছে, জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। যারা পবিত্র রমজান পালন করছেন তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn