সুজাত মনসুর-

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগ কি এখন সুসময় না দুঃসময় অতিবাহিত করছে? সবাই একবাক্যে বলবেন, গত ৬৮ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ এখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা দুই মেয়াদে আট বছরের অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত আছে ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হয়েছে।  আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্নতা অর্জন করেছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাত ভাগের উপরে। মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থান বেড়েছে। অর্থনীতিতে বিদেশ নির্ভরতা কমেছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মত বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করছি। জঙ্গি দমনে বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হতে পারি। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান। বিরোধীদল মুলত এখন কাগুজে বাঘ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এখন আর বটম লেস বাস্কেট নয়। বিশ্ব রাজনীতির পরিমন্ডলে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা এখন ফেলনা নন। সবাই এখন বাংলাদেশকে হিসেবে নিয়ে কথা বলে।

এক কথায় বলতে গেলে গত আট বছরে বাংলাদেশ যেভাবে সবদিক বিবেচনায় বিশেষ করে অর্থনীতিতে দ্রুতবেগে এগিয়ে গিয়েছে তা নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির জন্য সুসময়ের পরিচায়ক। আর এই কৃতিত্বের দাবিদার বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন প্রথম মেয়াদে মহাজোট আর দ্বিতীয় মেয়াদে চৌদ্দদলীয় জোট সরকার। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছে? নাকি আরো পিছিয়েছে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য এই সময়কালকে সুসময় কিংবা স্বর্ণযুগ বলা গেলেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এই সময়কালকে কি সুসময় বলা যায়? আমার বিবেচনায় না। কেন নয়? জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগের জন্য যে দুটি সময়কাল দুঃসময় হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যায় তাহলো, স্বাধীনতা-উত্তর সময়কাল এবং ১/১১ উত্তর সময়কাল।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অধিকতর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশটিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর খাই খাই মনোভাব আর দলে বসন্তের কোকিলদের সমাবেশ সে প্রচেষ্টার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। দলে ত্যাগি নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধু দলে চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে পারছিলেন না। মন্ত্রী-এমপিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের বিচার এড়িয়ে পুনরায় সংগঠিত হবার সুযোগ পাচ্ছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছত্রছায়ায় তারা ডালপাল বিস্তার করে। পঁচাত্তরের পনেরো আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পরাজিত শক্তিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশকে আবার মিনি পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কিন্তু পারেনি বঙ্গবন্ধু কন্যা আর আওয়ামী লীগের তৃণমুলের নেতাকর্মীদের আপোষহীন লড়াই-সংগ্রামের কারনে।

বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারনে ৭২ থেকে ৭৫-এর পনেরো আগষ্ট দেশ ও জাতি একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। দেশ ও জাতির জন্য সে সময়কাল পরিপুর্ণ সুসময় না হলেও স্বস্তি ছিল। বাঙালি জাতির ভরসা ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য ঐ সময়টা স্বস্তি ও সুখকর ছিল না। দলের সর্বক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পরেছিল। ত্যাগি ও আদর্শিক নেতাকর্মী অবহেলিত আর লুটেরা-ব্যবসায়ী আর দুর্বৃত্তদের কদর ও প্রাধান্য বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং দলের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসুচি বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। যার কারনে পরিবারসহ জীবন দিতে হয়েছে। নীতি-আদর্শহীন, ভোগ-বিলাসে মত্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে রক্ষা করতে পারেনি।
তারপর প্রায় তিনদশক পর বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা, ইতিবাচক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশ ও জাতির সামনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কাংখিত লক্ষ্যের দিকে। দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্তি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। মোদ্দাকথা দেশ ও জাতির জন্য বর্তমান সময়কালকে নিঃসন্দেহে সুসময় বলা যায়। কিন্ত যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি অত্যন্ত বৈরি স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে দেশ ও জাতির জন্য সুসময় বয়ে নিয়ে আসলেন, সেই আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবাষিকীতে এসে বলা যায়, আওয়ামী লীগ কিন্তু সুসময় নয়, ভয়াবহ দুঃসময় অতিবাহিত করছে। দলের চেইন অব কমান্ডের এমনই ভঙ্গুর অবস্থা যে, তৃণমুলের উপদলীয় কোন্দল নিরসনেও অনেক সময় দলীয় সভানেত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে।

দলের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অশালীনতাপুর্ণ স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি। লুটেরা আর হাইব্রিডদের দলে এনে নিজেদের উপদলগুলোর শক্তি বৃদ্ধির এক অশুভ প্রতিযোগিতার কারনে ত্যাগি নেতাকর্মীরা কোনঠাসা। এমপি-মন্ত্রীদের সাথে দলের নেতাকর্মীদের ফারাক বিস্তর। আদর্শহীনতা ও আর ভাই তোষণনীতি এমন পর্যায়ে যে, মনে হচ্ছে দলটি ক্রমান্বয়ে ভাই লীগে পরিণত হচ্ছে। নেতাকর্মী মাঠ-ময়দান-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ফেইসবুকে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যবসাপাতিতে মনোনিবেশ করছে। সেলফিবাজি আর ভাইদের সমর্থক গোষ্ঠির নামে চামচামির চরম অবস্থা। এত ভাই সমর্থক গোষ্ঠি চোখে পরে কিন্তু একদিন এমন কোন গ্রুপের সংবাদ চোখে পরলো না, যার নাম বঙ্গবন্ধু আদর্শ অনুশীলন কেন্দ্র কিংবা শেখ হাসিনার ভিশন ২১ এবং ৪১, কি ও কেন অনুশীলন, প্রচার ও প্রকাশনা কেন্দ্র বা গ্রুপ। লড়াই এখন ফেইসবুকে, তাও আবার নিজেদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই বেশি।

মাঝে মাঝে বিরোধীদলের কিংবা সুশীলদের বিরুদ্ধে যদিও লেখা হয়, তাও বুদ্ধিভিত্তিক নয় তেমন। হাতে গোনা কয়েকজনের ব্যতিত। অনেক স্ট্যাটাসই হয় অশালীনতার ভরা কিংবা ভুল বানানে ভরপুর। চামচা আর তোষামোদকারীদের রমরমা অবস্থা। সবার মধ্যে একটা না পাওয়ার বেদনা, খাই খাই অবস্থা। টাকা-পয়সা দিয়ে হলেও কোন কমিটির একটি সদস্য পদ হলেও বাগিয়ে নেয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মনোনয়ন বানিজ্য। পোষ্টার-ব্যানারে ক্ষুদ্র আকারে বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর ছবি দিয়ে নিজের ও প্রিয় ভাইয়ের ছবি যতটুকু সম্ভব বড় করা। বছরের পর বছর জেলা-উপজেলা কমিটির সম্মেলন না করা। সম্মেলন হলেও পুর্নাঙ্গ কমিটি না করা। দলের গঠনতন্ত্র-ঘোষনাপত্র কিংবা রাজনৈতিক সাহিত্যগুলো লেখাপড়া করার চর্চা কমে যাওয়া। এই যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম, এসবই হলো রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অসুস্থতার লক্ষন। সুতরাং অসুস্থতা কোন ব্যক্তির জন্য যেমন সুসময় নয়, তেমনি কোন রাজনৈতিক দলের জন্যও সুসময় নয়। অন্যদিকে, কোন অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কোন অবস্থায়ই শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

 বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কিংবা শেখ হাসিনার ভিশন ২১ ও ৪১ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে আগামী নির্বাচনে সরকারের উন্নয়ন আর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে পরাজিত করে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসা কঠিন হবে না। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন হতে পারে। মনে রাখতে হবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি কিন্তু একা নয়। তাদের সাথে যুক্ত হবে বাম-ডানের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। সাথে থাকবে বিদেশী শক্তি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারনে যারা অস্বস্তিতে আছে। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। যে জাতীয় পার্টি আজ সহায়কের ভুমিকা পালন করছে, তারাও উল্টো গান গাইতে পারে। অর্থাৎ লড়াইটা হবে আওয়ামী লীগ বনাম অন্যান্য। এমনকি আওয়ামী লীগের ভিতর থেকেও কেউ কেউ ঘরের শত্রু বিভীষনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সুতরাং দুঃসময় শুধু এখন নয়, ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে পারে। তবে, উপায় অবশ্যই আছে এই দুঃসময় কাটিয়ে ওঠে সুসময় ফিরিয়ে আনার। সম্ভাব্য বিপর্যয় ঠেকানোর। আর তা অসম্ভব কিছু নয়।

আওয়ামী লীগের রয়েছে এক মহাশক্তি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আর তাঁর সরকারের অভুতপুর্ব উন্নয়ন। তার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। নেতৃত্ব আপোষহীন ও বিচক্ষন। এখন শুধু প্রয়োজন দলকে আগাছামুক্ত করা। তুণমুল থেকে শুরু করে মুল দল ও সহযোগি এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর চেইন অব কমান্ড ঠিকঠাক করা। যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া। সরকারের উন্নয়নের কথাগুলো মানুষের মাঝে নিয়ে নেয়া। ভাইপ্রীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। তেলবাজ আর চামচাদের কোন অবস্থায়ই দলে কিংবা সরকারে প্রশ্রয় না দেয়া। জেলা-উপজেলা কমিটিগুলোর সম্মেলন সম্পন্ন করে ত্যাগি নেতাকর্মীদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়া। যদিও এ কাজগুলো করা খুবই কঠিন, তবুও করতে হবে। নতুবা দল, জাতি ও দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আর এবার যদি কোন রকমের বিপর্যয় ঘটে তাহলে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। সুতরাং জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২১ ও ৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে বুদ্ধিভিত্তিক, আদর্শিক, ত্যাগি নেতাকর্মীদের অধিকহারে সমাবেশ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগি-অঙ্গ সংগঠনগুলোকে গতিশীল, যুগোপযুগি করে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। এটা এখন সময়ের দাবি। আর তা যদি করা যায় তাহলে বলা যাবে আওয়ামী লীগের এখন সুসময়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সকল ত্যাগি নেতাকর্মীদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা। আমি সব সময়ই ইতিবাচক মানুষ। আর সেই ইতিবাচক চিন্তার আলোকেই বলতে চাই, আসছে দিন আমাদের। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবশ্যই আমরা বর্তমান সাংগঠনিক দুঃসময়কে পরাভুত করে সুসময় বয়ে নিয়ে আসব, আনতেই হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা,লন্ডন প্রবাসী লেখক, গবেষক

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn