সারাদেশের প্রায় ৩৬ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনিয়মের তদন্ত করতে গিয়ে পাওয়া গেল পিলে চমকানো তথ্য। ইতোমধ্যে ভুয়া সনদধারী ৭০০ শিক্ষকের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতা তুলছে। গত দেড় বছরে সন্ধান মিলেছে এসব জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীর। তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।  ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এ সনদ যাচাইয়ে ধরা পড়া ৫৫৬ অনিয়মকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের গৃহীত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত নেওয়ার জন্য ডিআইএ সুপারিশ করেছিল। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের বেতন-ভাতার টাকাও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত নেওয়া হয়নি।

তবে দুদক থেকে সম্প্রতি ওই শিক্ষকদের ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম অনুসন্ধানকারী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তারা জানান, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তদন্তে গেলেই এমন জাল সনদধারী পাওয়া যাচ্ছে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এ ধরনের সনদ ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু একাডেমিক সনদ নয়, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদ (এনটিআরসিএ), বিএড অথবা এমএড এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নট্রামসের কম্পিউটার শিক্ষা সনদের জাল কপিও মিলেছে তদন্তে।

এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু ব্যক্তি জাল সনদসহ নানা অসাধু উপায়ে এ পেশায় ঢুকে পড়েছেন। তাদের কারণে পুরো শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাল সনদ দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে সরকারি অর্থের অপচয় ঠেকানো হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও এ ব্যাপারে তাগিদ রয়েছে।

গত দেড় বছরে ৩৬ হাজার প্রতিষ্ঠানে শুধু তিন বিষয়েই ডিআইএ কর্মকর্তারা ধরতে পেরেছেন জাল সনদধারী ৫৫৬ জনকে। বিষয়গুলো হচ্ছে কম্পিউটার, লাইব্রেরিয়ান এবং বিএড। এর বাইরেও বহু শিক্ষকের মূল একাডেমিক সনদ জাল বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, এনটিআরসিএ’র একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জাল সনদে তারা এমপিভুক্তও হয়েছেন। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা- এই চার বিভাগে শিক্ষক নিবন্ধনে ভুয়া ধরা পড়েছে লাইব্রেরিয়ান ৩৬৭ জন, কম্পিউটারে ১৪৭ জন এবং বিএডধারী ৪২ জন। ভুয়া সনদধারী এই ৫৫৬ জন গত বছরের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে বেতন-ভাতা হিসেবে নিয়েছেন ১৫ কোটি ৭১ লাখ ৪১ হাজার ৭০০ টাকা। এই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। দেশের অন্য বিভাগগুলোয় জাল সনদধারীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। একই সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ে যারা জাল সনদে চাকরি করছেন, তাদের তালিকাও প্রস্তুত করছে ডিআইএ। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, তালিকায় ভুয়া সনদে চাকরিরতদের সংখ্যা ইতিমধ্যে সাত শ’ পেরিয়ে গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একটি অসাধু চক্র জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বছরের পর বছর চাকরি করছেন বলে জানিয়েছে ডিআইএ। জাল সনদের সিন্ডিকেট ভাঙতে সম্প্রতি দুদকও মাঠে নেমেছে। সম্প্রতি দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের সই করা এক চিঠিতে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ চারটি মহানগরীর জাল সনদধারী ৫৫৬ জন শিক্ষকের তথ্য চাওয়া হয়েছে। একই চিঠিতে মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরে জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিএড সনদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে রাজধানীর নামিদামি ১৫টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য রোধে মাঠে নামে দুদক। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ভুয়া সনদে চাকরি করা শিক্ষকের তালিকা চাওয়া হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, দুদকের চাহিদা অনুযায়ী ধরা পড়া সব শিক্ষকের তথ্য দিয়েছি।  দুদক আমাদের কাছে এসব শিক্ষকের নাম, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ-সংক্রান্ত তথ্য, আইডি ও বর্তমান কর্মস্থলের নাম চেয়েছিল। সেসব দেওয়া হয়েছে। তাদের সবাই কম্পিউটার, বিএড ও লাইব্রেরিয়ান জাল সনদধারী।

ডিআইএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তদন্তে গিয়ে শিক্ষকদের সনদ যাচাই করে প্রচুর জাল সনদ পাওয়া যায়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি তাদের নেওয়া অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। তবে মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে গিয়ে সে সুপারিশ অজ্ঞাত কারণে আটকে যায়। কারও বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

তবে এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মাউশি থেকে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। অবগত হওয়ার পর জাল সনদধারী কাউকেই কোনো কৃপা দেখানো হয় না। এর কোনো সুযোগও নেই।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn