উজ্জ্বল মেহেদী ও খলিল রহমান-

সুনামগঞ্জের হাওরে হাজার কোটি টাকার ফসলহানির ঘটনার পর দুটি মামলা হয়েছিল। ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে প্রথম মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে জেলা আইনজীবী সমিতির দায়ের করা মামলা আদালতের নির্দেশে দুদকের মামলার সঙ্গে একীভূত করা হয়। মামলায় আসামি ১৩৯ জন। গত তিন মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৩ জন। অভিযোগ উঠেছে, ১৩৯ আসামির মধ্যে ৩ জনকে ধরেই দুদক যেন দায়সারা। অন্য কোনো আসামি ধরার চেষ্টা নেই, মামলার তদন্তও চলছে ধীরগতিতে।

এবারের বোরো মৌসুমে গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে সুনামগঞ্জের হাওরে বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ফসলহানির ঘটনা ঘটে। জেলার ১৫৪টি হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। এতে আবাদ হওয়া ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ধানের ৯০ ভাগ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০টি কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলহানির পরই ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

দুদক সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলহানি ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম অনুসন্ধানে গত ১৩ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান ছিলেন দুদকের পরিচালক মো. বেলাল হোসেন। এই কমিটি গঠনের পরদিনই পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিনকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে মো. আফছার উদ্দিন, পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) মো. আবদুল হাই ও সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

দুদকের তিন সদস্যের ওই কমিটি সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা পরির্দশন, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। গত ২ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আলী খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদনে বাঁধ নির্মাণে পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসির গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ জুলাই সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা, বাঁধের কাজের ৪৬ জন ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

মামলার বাদী দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ। তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বেও রয়েছেন। ওই দিনই ঢাকা থেকে পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের বরখাস্ত হওয়া সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিন ও ইব্রাহিম টেড্রার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে একই অভিযোগে ৩ আগস্ট সুনামগঞ্জের বিশেষ আদালতে আরেকটি মামলা করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হক। এ মামলায় আসামি করা হয় ১৩৯ জনকে। দুদকের মামলার ৬১ আসামি এই মামলারও আসামি। এর বাইরে ৭৮ জন হলেন ৩৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর থেকে দুই মামলার অভিযোগসহ আসামির তালিকা একীভূত করে তদন্ত করছে দুদক।

পাউবো প্রকৌশলীসহ দুজনকে গ্রেপ্তারের প্রায় দেড় মাস পর গত ১৫ আগস্ট রাতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঠিকাদার খায়রুল হুদা ওরফে চপলকে গ্রেপ্তার করে দুদক। খায়রুল হুদা সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। এরপর আর কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। অভিযুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ফরিদপুরের ঠিকাদার খন্দকার শাহীন আহমদ, টাঙ্গাইলের মো. আফজালুর রহমান, সুনামগঞ্জের সজিব রঞ্জন দাশ, সিলেটের ঠিকাদার আবদুল হান্নান প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করলেও তাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না।

এ অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হক। তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে মামলা একীভূত হয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। আসামিরা কোথায়, মামলার তদন্তের কী অবস্থা—এসবের কিছুই জানি না। দুদকের কোনো কর্মকর্তা আমার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করেননি। কে কী করছেন বুঝতে পারছি না।’যোগাযোগ করলে মামলার তদন্ত সঠিকভাবে চলছে বলে দাবি করেন দুদকের মামলার বাদী মো. ফারুক আহমেদ। আসামি গ্রেপ্তার ও তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্তের ধীরগতির কথাটি ঠিক নয়। তদন্তের স্বার্থে হাওরের যেসব স্থানে বাঁধ হয়েছিল বা হয়নি, সেই জায়গা পরিদর্শন করতে হবে। সুনামগঞ্জের হাওরে এখন পানি, তাই এখন সেটা সম্ভব নয়। আসামি গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত তিনজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn