অদিতি খান্না-

ব্যাপক জাতিগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এর ফলে কর্মসংস্থান ও গৃহনির্মাণে সারা দেশের তুলনায় তারা পিছিয়ে রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ‘রেসিয়াল ডিজপেয়ারিটি অডিট’-এ উঠে এসেছে এমন তথ্য। সরকারি চাকরি বা পরিষেবায় জাতিগত বৈষম্য রোধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এই সমীক্ষার উদ্যোগ নেন।সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকাংশের বাস দেশটির অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত এলাকাগুলোতে। গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের সস্তা সোশ্যাল হাউজিং-এর ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী। তিনি বলেন, ‘এই জাতিগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বৈষম্যের অসহনীয় মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একইসঙ্গে সরকারকে অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। এই ঘটনা বারবার সামনে এসেছে। এখন আমাদের এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’

চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এই সমীক্ষার পরিসংখ্যানে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কালো ও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব প্রায় দ্বিগুণ। সারা দেশে জনগণের জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যদিও পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের হারে উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তবে এই জনগোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় তারা কম বেতনের পেশায় নিয়োজিত। ঘণ্টা হিসেবে পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি কর্মীদের বেতনের হার সর্বনিম্ন। ২০১৩ সালের শেষ তিন মাসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্মীদের তুলনায় প্রতি ঘন্টায় তাদের আয় ছিল ৪ দশমিক ৩৯ পাউন্ড কম। বাংলাদেশি কর্মীরা মূলত নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের প্রতি মনোনিবেশ করেন। প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বেশি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের কর্মী। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে কাজ করেন প্রতি পাঁচজনে একজন বাংলাদেশি।

পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর চাকরির হার খুবই কম। তাদের কর্মসংস্থানের হার মাত্র ৩৫ শতাংশ। ৫৯ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি নারীদের কর্মসংস্থান ন্যূনতম পর্যায়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। সমীক্ষায় উঠে আসা একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা চাকরির চেয়ে নিজেরা কিছু করাকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কাজ করার মতো বয়স হয়েছে এমন বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজনের বেশি মানুষ স্বনির্ভর। অন্য যে কোনও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এটা সর্বাধিক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা গেছে, স্কুলগুলোতে শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও ভালো করছে। তারা ভালো ইংলিশ বলে। এই প্রবণতা পুরনো প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায় না। কিন্তু সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী, তাদের অবস্থান খুব ইতিবাচক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এ জনগোষ্ঠীর লোকজন কম জায়গায় ঠাসাঠাসি করে বসবাস করেন। ২০১৫-১৬ সালে এ সমস্যা ৩০ শতাংশ ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিবারের সদস্যদের ভুগিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ পরিবারগুলোর তুলনায় এ হার অনেক বেশি। তাদের ক্ষেত্রে এই হার ২ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা, তাদের নিয়ে করা পরিসংখ্যানসহ বিভিন্ন আপডেট নিয়ে নতুন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে ব্রিটিশ সরকার। ওয়েবসাইটটির ঠিকানা www.ethnicity-facts-figures.service.gov.uk এই ওয়েবসাইটে স্থান পেয়েছে কয়েক হাজার পরিসংখ্যান। ১৩০টিরও বেশি বিষয়বস্তু নিয়ে এসব পরিসংখ্যান করা হয়েছে। এই বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলো। ফলে এ সম্পর্কিত তথ্যাবলির জন্য এই ওয়েবসাইট হবে একটি স্থায়ী ঠিকানা। বিভিন্ন সময়ে এতে নতুন নতুন ডাটা যুক্ত হবে। সরকারের এই কাজের নেতৃত্ব দেবেন যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ দফতরের প্রথম প্রশাসনিক সচিব দামিয়ান গ্রিন। তার অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ ইউনিট সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সমন্বয় করবে। এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তিনি বলেন, সমতা ও সুযোগ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ব্রিটেন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যগুলো নিশ্চিতভাবেই এর লক্ষণগুলো দেখাবে যে, কিভাবে আমাদের এমন একটি দেশ নির্মাণ করতে হবে যা প্রত্যেকের জন্য কাজ করে!ডাউনিং স্ট্রিটে নিজের প্রথম বক্তব্যে ব্রিটিশ সমাজে বৈষম্য বা অবিচার মোকাবিলা করার কথা বলেছিলেন থেরেসা মে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তিনি এই সমীক্ষার আদেশ দেন। এই সমীক্ষা সম্পন্ন করতে পুরো এক বছরজুড়ে ব্রিটিশ সরকার সারা দেশে শত শত অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn