মিজানুর রহমান |

বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে আসছেন জর্ডানের রানী রানিয়া আল আবদুল্লাহ। আগামী সপ্তাহে বিশেষ বিমানে চড়ে সরাসরি তিনি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা কক্সবাজার যাবেন। সেখানে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বর্মী বর্বরতার লোমহর্ষক কাহিনীগুলো শুনবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মানবতার কল্যাণে বৈশ্বিকভাবে সামজিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী কুইন রানিয়ার কক্সবাজার সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি বিশেষ করে ইস্যুটির ‘সংবেদনশীলতা’ বাড়বে। সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বাঙ্গনে এখন প্রতিনিয়ত সরব বাংলাদেশ। এ নিয়ে গতকালও সরকারের তরফে ঢাকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সক্লুসিভ ব্রিফিং হয়েছে।

সেখানে বর্মী বাহিনীর বর্বরতা বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পরিকল্পিতভাবে আগ্রাসনের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। রাখাইনে হত্যাযজ্ঞ বন্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও দেশটির সরকারের ওপর বৈশ্বিক চাপ আরো জোরালো করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে আরো সরব হবেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক যেখানে যেভাবে সুযোগ পাবেন সেখানে সেভাবেই পরিস্থিতির ভয়াবহা তুলে ধরা এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর অনুরোধ অব্যাহত রাখবেন তারা। গত বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের সংকটসহ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উপর উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের দুর্দশার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছে বাংলাদেশ। সেখানে বলা হয়েছে, অল্প সময়ে বাস্তুচ্যুত বিপুল (লাখ, লাখ) রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয়ের কারণে এখানে এক মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফিলিস্তিন সমস্যার মতো রোহিঙ্গা সংকটেরও স্থায়ী সমাধান চেয়েছে বাংলাদেশ। এতে আবারও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্মিলিত ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মাসুদ নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, ‘ইতিপূর্বে ও সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের দ্বারা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বিপুল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেয়ার প্রেক্ষিতে আমরা এই সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছি এবং সঙ্গত কারণেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দীর্ঘস্থায়ী এই অবৈধ দখল ও ফিলিস্তিনি জনগণের মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছি। বাংলাদেশ গত তিন দশক ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলা করছে। এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সম্মিলিত ও দৃঢ় পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। নিরাপত্তা পরিষদ এসব দীর্ঘস্থায়ী সংকটের শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ঐকমত্য প্রদর্শন করছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তা না করলে দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিবে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোভাবের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে দুই রাষ্ট্র সমাধান কাঠামোর ভিত্তিতে একটি স্বাধীন, টেকসই, সুসংহত ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারসহ ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। বাংলাদেশের দূত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের কার্যকর মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বর্ধিত ও পর্যাপ্ত তহবিল সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থানও তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে বৈঠকের টপ এজেন্ডা রোহিঙ্গা সংকট: এদিকে আগামী সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার যৌথ পরামর্শ সভা এবং আগামী মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার পার্টনারশিপ ডায়ালগে মুখ্য আলোচনা হবে রোহিঙ্গা সংকট। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুও থাকবে। তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকা রোহিঙ্গা সংকট নিয়েই প্রভাবশালী দেশ দুটির কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে নজর থাকবে ঢাকার। উল্লেখ্য, আগামী রোববার কানাডার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ওই বৈঠক হবে। বৈঠকে নেতৃত্ব দিতে ঢাকা আসছেন কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক সহকারী উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড ববিঅ্যাশ। ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাই কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদেরও আরো জানার এবং ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ততার আগ্রহ রয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের সব সংকটকালেই কানাডা পাশে ছিল, আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। আসন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি, সুশাসন, নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়েও আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। কানাডায় বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি নুর চৌধুরীর ফেরতের বিষয়টিও আলোচনায় তুলবে ঢাকা। সেখানে উন্নয়ন সহযোগিতা, নারীর ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, শ্রমমান, বিনিয়োগসহ দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসন্ন পৃথক দুটি বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn