তানভীর সোহেল–

সংসদ ভেঙে দিয়ে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে মনে করছে বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সরকারের অনমনীয় অবস্থান ও এই দাবির বিষয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় দলটির সামনে আর কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের তিনজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনে বিএনপির দেওয়া প্রস্তাবের ‘উল্টো’ প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সরকারের অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও তেমন কিছু করা সম্ভব বলে মনে করেন না তাঁরা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেও এ নিয়ে সুষমা কোনো মন্তব্যই করেননি। বরং নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোর দেন। বিএনপির ওই নেতারা বলেন, শেষ পর্যন্ত রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই বিএনপিকে দাবি আদায় করতে হবে। তবে আন্দোলনের আগে নির্বাচন কমিশন তাদের দেওয়া প্রস্তাবের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির ওই নেতারা দাবি করেন, সহায়ক সরকারের ব্যাপারে ভারতের কোনো বক্তব্য না থাকলেও সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চাওয়াকে ইতিবাচক মনে করছে বিএনপি।

আগামী বছর একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একটা সমঝোতা হবে বলে মনে করলেও বিএনপি এখন মনে করছেন, রাজপথে কঠোর আন্দোলন না হলে সরকার বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবে না। সরকার নিজেদের অধীনে একতরফা বা কারচুপির নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবে। এ কারণে দলটির চিন্তা সংলাপের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা। বিএনপি নেতারা মনে করেন, আন্দোলনের কারণেই ২০১৩ সালে এই সরকার বিএনপিকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারেও আমন্ত্রণ জানায়। তাঁরা মনে করছেন, সরকার এখন দেশে-দেশের বাইরে নিজেদের অবস্থান আগের চেয়ে পাকাপোক্ত করেছে। তবে সরকারের এখন একমাত্র দায় একটি ভালো নির্বাচন করা, সব দলকে নির্বাচনে আনা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও মনে করেন, কোনো দেশ বা বাইরের কেউ এসে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে না। বিএনপির দাবি আদায় করতে প্রয়োজনে লড়াই করতে হবে। ২৩ অক্টোবর রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় ফখরুল আরও বলেন, বিএনপি কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু দাবি উত্থাপন করেছে। তাদের চাওয়া, যারা ভোটে জিতবে, তারাই ক্ষমতায় আসবে। বিএনপি অতিরিক্ত কোনো সুযোগ চাইছে না। সবার সমান সুযোগ চাইছে।

গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীর নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান নিয়েও সেখানে কথা হয়েছে। বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর ও বিএনপির সৌজন্য সাক্ষাৎ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মনে হয়নি, এই সরকারের ব্যাপারে বা আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে। দেশটি বলছে, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় এবং সব দলকে নির্বাচনে আনা সরকারেরই দায়িত্ব। এটা বিএনপির জন্য ভালো হয়েছে। বিএনপি এ বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। ওই দুই নেতা মনে করেন, বিদেশিদের দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। সে জন্য আন্দোলনের মাধ্যমেই দলটির দাবির যৌক্তিকতা, দাবির পক্ষে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা প্রমাণ করতে হবে।

স্থায়ী কমিটির ওই দুই সদস্য বলেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের কথা একেবারেই ভাবছে না। বরং নির্বাচনে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কী করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছে।  বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকুক—এটা সবাই চায়। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটা ভালো নির্বাচন দরকার। সে জন্যই সহায়ক সরকারের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, দাবি আদায়ের ভালো উপায় আলোচনা। সেটা না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তবে এখনই কোনো আন্দোলনের ডাক দেওয়ার ইচ্ছা বিএনপির নেই। এ জন্য আরও সময় নেবে দলটি। আপাতত তারা সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে। সভা-সমাবেশের মতো কিছু কর্মসূচি দেবে। সরকার এ ধরনের কর্মসূচিতে বাধা দেয় কি না, সেটা দেখা পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কিছু কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের আছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা দেবেন।

আগামী ৭ নভেম্বর দলটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস পালন করবে। সে জন্য ঢাকায় একটি সমাবেশ করার কথাও ভাবছে তারা। সরকার সমাবেশ করার অনুমতি দেয় কি না, সেটাও দেখতে চায় দলটি। বিএনপির স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের মনোভাবও জানতে চায় দলটি। বিএনপি নেতারা বলেছেন, এ বছরের শেষ দিক থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় সব সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনে অংশ নেবে। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়াটাকেও আন্দোলনের অংশ মনে করছে বিএনপি। ভোটে বিএনপির জয় হলে সেটাও সরকারকে চাপে ফেলতে সহায়তা করবে বলে মনে করে দলটি। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কাছে বিএনপির দাবি পৌঁছাবে। সম্ভাব্য সহায়ক সরকারের রূপরেখা সাধারণ মানুষের কাছে নেওয়া সহজ হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn