মারুফ খান মুন্না :: আধ্যাত্মিক নগরী খ্যাত সিলেটে সামাজিক অপরাধের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে এ বছর। পুলিশ, বেসরকারি সংগঠন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র থেকে পাওয়া অপরাধের সংখ্যা ও ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে  রাজনৈতিক কোন্দল, বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার, মাদকবিষয়ক ঘটনার সাথে সাথে যোগ হয়েছে পারিবারিক কোন্দল, ধর্ষণ, শিশু অপহরণ ও ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানান অপরাধমূলক কর্মকান্ড। আর  এসব অপরাধের জের ধরেই  বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বাদ যাচ্ছেনা শিশুরাও। বাংলাদেশে অবস্থান করা ‘অবৈধ’ বিদেশি নাগরিকরাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন ‘অবনতি’ হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সিলেটের সাধারণ মানুষ। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিংবা পারিবারিক কলহের জের ধরে হত্যা, নারী নির্যাতন এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে সিলেটে। গত তিন মাসে সিলেটের বিভিন্ন হোটেল এবং রেল লাইন থেকে এমন কয়েকটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।বিভিন্ন পাথর কোয়ারীতে শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তাছাড়া পুর্ব শত্রুতার জের ধরে খুনে উত্তপ্ত সিলেট। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দিতে জোড়া খুন, জৈন্তাপুরে ওয়াজ মাহফিলে খুন, ওসমানীনগরে মা-ছেলে খুন, মসজিদের জায়গা নিয়ে বিরোধে গোয়াইনঘাটে জোড়া খুনসহ সর্বশেষ মিরাবাজারে অজ্ঞাত কারণে মা-ছেলেকে খুনের ঘটনায় আতঙ্কিত শান্তির নগরী সিলেট।
২০১৮ সালের প্রথম দিনেই সিলেটে গ্রুপিং রাজনীতির বলি হন ছাত্রদলকর্মী শিমু। তিনদিন পর (৪ জানুয়ারী) সিলেটের গোলাপগঞ্জে ১৬ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ধর্ষণের অভিযোগে লিটন ওরফে সাদ্দাম (২৫) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারও তিনিদিন পর আবারো খুনোখুনিতে মেতে উঠে সিলেট। এবার পাঠার বলি ছাত্রলীগকর্মী তানিম খান। এর এক সপ্তাহ পর আবারো ধর্ষণ। ১৪ জানুয়ারী বিয়ের কথা বলে শাবি শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম তার প্রেমিকাকে সিলেটের আখালিয়া এলাকার একটি মেসে নিয়ে যান। পরে সেখানে আটকে রেখে তিন দিন ধর্ষণ করেন তিনি এমন অভিযোগে মামলা করেন তার প্রেমিকা।তবে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা হলো এসব ধর্ষণ থেকে বাদ যাচ্ছেনা তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ুয়া ৫-১০ বছরের কোমলমতি শিশুরা। গত ২১শে ফেব্রুয়ারী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশু ভাতিজিকে ধর্ষণের অভিযোগে তার চাচা মিজানুর রহমানকে (১৭) গ্রেফতার করে পুলিশ। এর দুইদিন পর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের জয়নাল আবেদীন কলেজের একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্র রিমন হোসেনকে (১৯)তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক করে পুলিশ। গত ৫ মার্চ সিলেট নগরীর শাহপরান থানাধীন বাঘমারা এলাকায় চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১১) ধর্ষণের অভিযোগে চাঁদপুর ের মতলব থানার দক্ষিণ উপাদীর (বর্তমানে শাহপরান থানাধীন উত্তর জাহানপুর এলাকার ভাড়াটিয়া) সিদ্দিক মিয়ার ছেলে মিলন মিয়া (৩০), শাহপরান থানার উত্তর জাহানপুর এলাকার রিফাকত হোসেন কমরেডের ছেলে সোহান আহমদ (২৬) নামে দুই আসামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রেমিকার করা একটি ধর্ষণ মামলায় গত ১৩ই মার্চ কারাগারে যেতে হয়েছে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ নেতা এম নোমান হাসান খানকে। ১৯শে মার্চ সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে ৫ বছরের এক শিশুকে আইসক্রিম খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে ব্রাম্মনগাঁও গ্রামের তাজুল ইসলামের পুত্র মুসলিম উদ্দিনকে (১৮) আটক করে তাহিরপুর থানা পুলিশ।
শিশুরা ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহৃত হচ্ছে। সিলেটে শুধু গত তিন মাসে অন্তত ১০জন শিশু অপহৃত হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি সিলেট সদর উপজেলার এয়ারপোর্ট থানাধীন লাক্কাতুরা চা-বাগান এলাকা থেকে নয়ন দাস (১২) ও অমিত মারাক (১১) নামের দুই শিশু নিখোজ ছিল। নগরীর উপশহর থেকে নিখোঁজ হওয়া মুহাইমিনুর রহমান ভূঁইয়া (১৬) নামের কিশোরকে কুমিল্লা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে গত ২৭ মার্চ। নিখোঁজ হওয়ার এক সাপ্তাহ  পর তার সন্ধান পাওয়া যায়।  এছাড়া জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখাসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে নিখোজের পর উদ্ধার করা হয় শিশুদের। অনেক সময় নিখোজের পর শিশুদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।এদিকে সিলেট শহরে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ছিনতাই। সিলেটে পুলিশী টহল থাকা সত্ত্বেও ছিনতাইর মতো অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভবপর হচ্ছেনা। যাত্রীবাহী সিএনজির মধ্যে ছদ্মবেশী ছিনতাইকারীরা সক্রিয় সিলেটে। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত  ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন কেউ না কেউ। অনেক ক্ষেত্রে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতের শিকার হচ্ছেন অনেকজন। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সর্বষেশ প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রাক্তন শাবি শিক্ষার্থী মাহিদ আল সালামকে।অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা অবনতি নয়, বরং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই সিলেটে বেড়ে চলেছে আত্মহত্যা, খুন, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা। তবে সুজন জেলা কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেটভিউকে জানান, ‘এটা সত্যি যে গত কয়েকমাসে সিলেটে অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়ে গেছে। সুশাসনের অভাবেই এমনটা হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘পুর্বের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিচার না হওয়া এবং প্রশাসনের দায়সাড়া দ্বায়িত্বের কারণে অপরাধ বেড়ে গেছে।’
সিলেটের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব সিলেটভিউকে জানান, সিলেটের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। ধর্ষন, অপহরণ কিংবা যেকোন ঘটনায় ভিকটিমকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা এবং আসামীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। ছিনতাই প্রতিরোধে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা।তিনি আরো জানান, অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনতে পুলিশের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য এবং সমাজের সর্বস্তরের সর্বপেশার মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। নিজ নিজ জায়গা থেকে সবাই সচেতনতা গড়ে তুললে অপরাধ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn